টালির চাল ছাওয়া লতাপাতার ফোকরে কচি একখান লাউই সম্বল হোগলবেড়িয়ার বিশু বিশ্বাসের।
‘‘এই লাউডাই বাজি থাকল ভাইটি আমার! বুঝে নেবো উনিশে!’’
চোখ ঠেরে হেসে যাকে কথাটা বলছেন, ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল থেকে মাটিতে পা রেখে সেই ছেলেটি এক পলক মেপে নেয় পাতার ফাঁকে লাউ। তার পর মুচকি হেসে বলে— ‘‘বেশ চাচা, তা হলে ওই কথাই থাক। হাওয়াই চটি ছিঁড়লেই লাউয়ের ঘণ্ট!’’
হোগলবেড়িয়া জায়গাটা নদিয়ায়, বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা। তিরতিরে মাথাভাঙায় হাঁটুজল পেরোলেই ও পাশে কুষ্টিয়া। সেখানেও লাউ ঝোলে মাচায়। পশ্চিম থেকে হাওয়া এলে লোকে বলে ‘ইন্ডিয়ার বাতাস’। সে তল্লাটেও লোকে এখন বাতাস শুঁকছে — ‘‘কী হবে গো কর্তা? দিদি শেষে হেরে যাবে নাকি?’’
রকে রাস্তায় ফুলশয্যায়, বাজারে মাজারে ধাপার ধারে দিনরাত হিসেব চলছে। এমনই তার চোট যে বৈশাখী সন্ধ্যার আইপিএলও আপাতত ফিকে! গত এক মাসে বাঙালি যা অঙ্ক কষে ফেলেছে এবং আগামী এক সপ্তাহে কষবে, সময়কালে কষলে মাধ্যমিকে একশো পাওয়া বাঁধা ছিল।
গণ্ডগোল খালি একটাই— অঙ্ক সহজ, কষেও ফেলছে সকলেই, কিন্তু একের উত্তর অন্যের সঙ্গে মিলছে না। কারও দিদি ১৭০, দাদা ১২০ তো কারও ঠিক উল্টো। এক দলের হিসেব বলছে, টাফ ফাইট, যা হবে একেবারে গায়ে-গায়ে, ১৪০-১৫০।
যা শুনেই উত্তরপাড়ায় শিবুদার চায়ের দোকানে টেবিলে ঘুষি মেরে ভাঁড় উলটে ফ্রেঞ্চ কাট মুকুল মাস্টার চেঁচিয়ে উঠছেন— ‘‘গায়ে-গায়ে না হাতি! বাংলার ট্রেন্ডই বোঝেন না দেখছি। যাকে দেয়, ঝুলি ভরে দেয়।’’ বলেই হাতে গরম হিসেব— ‘‘২০০১ সালে ‘এ বার নয় নেভার’ বলে কংগ্রেসকে ট্যাঁকে নিয়ে দিদিমনি পেয়েছিলেন মোটে ৮৬টা সিট। বাম ১৯৯। ২০০৬-এ ব্র্যান্ড বুদ্ধ ২৩৫, দিদিমনি ২৯, কংগ্রেস ২১। গত বার ৬২-২২৭। এ বারও ২২০ ছাড়িয়ে যাবে। বাজি রাখতে পারি!’’
‘হয়ে যাক বাজি!’
বালি থেকে বালিগঞ্জ, দিঘা থেকে দার্জিলিং, কোচবিহার থেকে কালীঘাট এই একটাই কথা এখন মুখে-মুখে — হয়ে যাক বাজি!
চায়ের দোকান, পাড়ার মাচা, মেসবাড়ির ছাদ, লোকাল ট্রেন, ভিড় বাস, মেট্রো, অফিসপাড়ার গলি, এই একটাই কথা— হয়ে যাক...
তিন কেজি পাঁঠার মাংস (কাঁথি)
ভীমনাগের সন্দেশ (চাঁদনি চক)
এক দোকান লোককে ভাঁড়ে চা (হরিশ্চন্দ্রপুর)
ফ্রি দিঘা ট্রিপ (উলুবেড়িয়া)
দামি বিলিতি (দমদম)
এক গাছ ল্যাংড়া (ইংরেজবাজার)
মাচার কচি লাউ (হোগলবেড়িয়া)
.....কী নেই? কোথায় নেই?
মোবাইল থেকে মোবাইলে ছুটছে হিসেব— ফেসবুক ভেসে যাচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপ জ্বলে যাচ্ছে। ‘সেন্ট্রাল আইবি’ থেকে ‘নিয়েলসেন’, সাদা কাগজে নীল বলপেনের আঁচড়ে ‘তৃণমূল ভবন’ তো কেন্দ্র ধরে-ধরে ‘আলিমুদ্দিন’—কারও নাম বাদ নেই। ভারী নামের আড়ালে আসলে বাজার মাত করছে পাড়ায়-পাড়ায় টেনিদা-ঘনাদাদের পাটিগণিত!
করছে কি আর সাধে?
নির্বাচন কমিশন আর পুলিশের দাপটে ভূতেদের দফারফা। নীরব জনতা ভোট দিয়েছে ঢেলে, বিশেষ করে চার নম্বর দফা থেকে। কিন্তু কাকে দিল? দাদা-দিদি কেউই নিশ্চিত
হতে পারছে না। তার উপরে বিজেপি নামক ফ্যাঁকড়া তো আছেই।
অবস্থা এমনই যে ভোট মিটতেই সাংবাদিককে এসএমএস করে এক পার্টির তরুণ তুর্কি জানতে চাইছেন, ‘‘ওদের (উল্টো শিবিরের) হিসেবটা জানতে পারলেন? কত বলছে?’’
অবস্থা এমনই যে রোজ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বীরভূমের এক দুঁদে নেতার। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন অজয়ের ধার ধরে এক সার ঢাকের শব্দ এগিয়ে আসছে— চড়াম চড়াম চড়াম... কিন্তু কাদের ঢাক? কাদের কাঠি? কাদের হাতে বাঁশের লাঠি?
অবস্থা এমনই যে বাগবাজারের ঘাটে বসে সাদা লুঙ্গি-ফতুয়া পরা এক প্রবীণ বলে ফেলছেন, ‘‘১৯৬২ থেকে ভোট দেখছি রে ভাই, এমন দেখিনি। এত ভাল ভোট দেখিনি, এত বেশি অনিশ্চিত ভোটও দেখিনি। কখনও এত বাজি ধরা কেউ দেখেছে?’’
সত্যিই! সবাই সবাইকে জিগ্যেস করছে, কী হবে? হইচই ফেলে দেওয়া ভোট তো আগে কম হয়নি— ২০১১ সালে পরিবর্তনের ভোট, ২০১৪-য় মোদীর ভোট। তখন কি এত বাজি ধরেছে লোকে? এ বার আবার ফল বেরোতেও এত দেরি। এতগুলো দিন কাটবে কী করে? জনতা তেড়ে বাজি ধরছে আর নেতানেত্রীরা দিন-দিন আরও নার্ভাস হচ্ছেন!
ক’দিন আগেই উত্তরের এক জেলা থেকে তৃণমূল ভবনে ফোন করে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের দিনক্ষণ জানতে চেয়েছিলেন এক লোকাল নেতা— ‘‘মানে, বলছিলাম কী, তা হলে ট্রেনের টিকিটটা কেটে রাখতে পারি, রিজার্ভেশন পেতে ঝামেলা হয় না...।’’ উত্তরে শুনেছেন মুখ-ঝামটা, ‘‘ছাড়ুন তো এখন ও সব কথা!’’
সাধে কি আর কবিপক্ষে বাঁয়া-তবলা তুলে রেখে অঙ্ক নিয়ে ঘেঁটে আছে বাঙালি? ডোমকল বাজারের চায়ের দোকান আব্দুল কাদেরের। এক মুখ বিরক্তি নিয়ে বলছেন, ‘‘খবরের কাগজ পর্যন্ত রাখার উপায় নেই! আগে টুকটাক তাসের হিসেব লিখত খদ্দেররা, এখন খালি ১১০+, ১৩২, ১৫৫, ১৮৩+ লিখেই ভরিয়ে দিচ্ছে। শুধু আমার দোকানেই একশো থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বাজি ধরা হয়েছে।’’ দমদমের মেসে তো মোচ্ছবের ছক পুরো তৈরি। তুমুল বাজি ধরা চলছে। পাল্টা বাজিও ধরে রেখেছে অনেকে। এক বন্ধুর সঙ্গে দাদার হয়ে বাজি ধরে, অন্য বন্ধুর সঙ্গে একই বাজি দিদির হয়ে। খানাপিনার ফাটফাটি আইটেম সব। যে-ই জিতুক, পার্টি হচ্ছেই।
তা হোক... কিন্তু ১৯ মে কী হচ্ছে?
মাথা ঝাঁকিয়ে নারায়ণগড়ের এক কমরেড বলছেন— ‘‘যা হওয়ার হতে দিন তো মশাই! এক মাস ধরে ভোট হল, এখন রেজাল্টের জন্য হাঁ করে বসে থাকা। আর ভাল্লাগে না!’’
তা বটে! এ ক’টা দিনে বাজি ধরা তা হলে আরও বাড়বে? ‘না’ বলছেন?
হয়ে যাক বাজি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy