Advertisement
২০ মে ২০২৪
ভয় উড়িয়ে ভোট/২

বড়জোর মেরে ফেলবে, তবু পিছু হটবো না

গুটিগুটি পায়ে বুথ অবধি পৌঁছতেই এ বারও দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল ভোট-লুঠেরার দল। দু’এক ঘা বসিয়েও দেয় কয়েক জনকে। এটুকু করেই নিশ্চিন্ত ছিল তারা। ভেবেছিল, গত দু’বারের মতো এ বারও যে যার ঘরে ফিরে যাবে।

অন্য গুলাব গ্যাং। জামালপুরে নারীবাহিনী নিয়ে গুন্ডাদের প্রতিরোধ করার কাহিনি শোনাচ্ছেন মালা চালক। ছবি: বিকাশ মশান।

অন্য গুলাব গ্যাং। জামালপুরে নারীবাহিনী নিয়ে গুন্ডাদের প্রতিরোধ করার কাহিনি শোনাচ্ছেন মালা চালক। ছবি: বিকাশ মশান।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
জামালপুর শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫২
Share: Save:

গুটিগুটি পায়ে বুথ অবধি পৌঁছতেই এ বারও দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল ভোট-লুঠেরার দল। দু’এক ঘা বসিয়েও দেয় কয়েক জনকে। এটুকু করেই নিশ্চিন্ত ছিল তারা। ভেবেছিল, গত দু’বারের মতো এ বারও যে যার ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু বছর তিরিশের এক সাদামাঠা গৃহবধূ যে আরও এক দল মহিলাকে সঙ্গে করে পাল্টা হুঙ্কার ছেড়ে ‘মারবি? মার দেখি’ বলে বাঁশ-লাঠি হাতে তেড়ে গিয়ে ছবিটা উল্টে দেবেন, সেটা তারা কল্পনাই করেনি!

বউকে মারধর করা স্বামী বা গণতন্ত্র লুঠতে আসা রাজনীতিকরা পিছু হঠেছিল গোলাপি শাড়ির দল ‘গুলাব গ্যাং’-এর প্রতিরোধের মুখে। উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডের সেই ঘটনা সামনে রেখে তৈরি হয়েছিল সিনেমাও। উপরের ছবিটা রুক্ষ বুন্দেলখণ্ডের নয়। গ্রামবাংলার। বর্ধমানের জামালপুরের দাসপুর গ্রাম ভোটের দিন দেখল প্রতিরোধের এই ছবি। ‘গুলাব গ্যাং’-এর মহিলাদের দল যেমন অত্যাচার ঠেকাতে তিলেতিলে বেড়েছিল, তেমনই গত ক’দিন ধরে একটু একটু করে বেড়েছে দাসপুরের খেতমজুর পরিবারের বধূ মালা চালক আর তাঁর দলবলও।

আর সেটাতেই বাজিমাত। এ দিন মালারা ঘুরে দাঁড়াতেই দাসপুরের কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২২৫, ২২৬ নম্বর বুথে গিয়ে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। গত পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটে অবাধে গণতন্ত্র লুঠ হতে দেখেছেন যাঁরা।

গত লোকসভা ভোটে জামালপুরে ৪৫ শতাংশ পেয়েছিল তৃণমূল। বাম এবং কংগ্রেসের ভোট জুড়লেও প্রায় চার শতাংশের ফারাক। মূলত দিনমজুর, খেতমজুরদের গ্রামের ছাপোষা মানুষগুলো তাই এ বার বুথমুখো হতেই সাহস পাচ্ছিলেন না। এটাই বরদাস্ত হয়নি মালার। তাঁর যুক্তি, মূলত বাম সমর্থকদের এলাকা বলে তৃণমূল জমানায় এখানে অধরা উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় যে রাস্তা হওয়ার কথা ছিল, সেটা আধাখেঁচড়া অবস্থায় পড়ে। ১০০ দিনের প্রকল্পের জব-কার্ড, বিপিএল কার্ড, রেশন কার্ডে নাম তোলার মতো বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে তৃণমূল নেতাদের চড়থাপ্পড়ও জুটেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে ভোটের দিন ঘরে আটকে থাকার অভিজ্ঞতা। মালার দাওয়াই, ‘‘অনেক সয়েছি। পাল্টা দিই না, দেখি কী করে!’’

প্রথমে অবশ্য কেউ ভরসা করেনি। কিন্তু মালার ছায়াসঙ্গী জয়া বিশ্বাস, টুম্পা বিশ্বাস, চম্পা সিংহেরা বলছেন, আস্তে আস্তে গ্রামের মহিলারা বিশ্বাস করতে শুরু করেন ‘জোটেই শক্তি’র তত্ত্বে। হপ্তা তিনেক আগে থেকে শুরু হয় মহিলা মহলের তোড়জোড়—আত্মরক্ষার অস্ত্র (অস্ত্র মানে বাঁশ আর লাঠি!) জোগাড়, একসঙ্গে টহল।

খবর ছিল শাসক শিবিরের কাছে। মালার অভিযোগ, স্বামী এবং তাঁর পাশাপাশি তাঁদের দুই শিশুপুত্রকে নানা রকম শাসানি, এমনকী ছুরি মেরে খুনের হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ নিতে গড়িমসি করে পুলিশ। কিন্তু যে হুমকি দিয়েছিল, তাকে চিহ্নিত করে মালা পুলিশকে বাধ্য করেন অভিযোগ নিতে। বলেন, ‘‘আখেরে লাভ হয়েছিল। খেপে উঠে এককাট্টা হয় গ্রামের লোকজন।’’

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২২৫, ২২৬ নম্বর বুথের ভোটাররা বুথের কাছাকাছি পৌঁছতেই মারধর, গালিগালাজ, হুমকি শুরু। অনেকেই বাড়ির পথ ধরেন। অবস্থা দেখে মাঠে নামে মালার ‘গ্যাং’। প্রায় জনা পঞ্চাশ মহিলা বুথে পৌঁছতেই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসে গুন্ডারা। তারা চড়াও হতেই আঁচলের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে লাঠি আর বাঁশ। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সব ঠান্ডা।

জামালপুরের তৃণমূল প্রার্থী উজ্জ্বল প্রামাণিকের অবশ্য দাবি, ‘‘সব অভিযোগ মিথ্যা। আমাদের ছেলেদের বিনা কারণে মেরেছে ওরা।’’

কিন্তু ঘটনাটা বুকে বল জোগাচ্ছে বাম নেতাদের। জামালপুরের সিপিএম জোনাল কমিটির সম্পাদক সমর ঘোষ যেমন বললেন, ‘‘মনে হচ্ছে, এলাকাটা এ বার বের করে নেব। মালা যে ভাবে লড়েছে!’’ মালার স্বামী দেবু চালকও ভরসা পাচ্ছেন। বলছেন, ‘‘ওদের দাপটে গ্রামের বুথগুলোয় তৃণমূল এ বার জিতলে হয়! যদি ওরা জিতেও যায়, টক্কর নিয়ে নেব।’’

মালা জুড়ছেন, ‘‘আর কত খারাপ হবে? বড় জোর মেরে ফেলবে! তা বলে জায়গা ছাড়ব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016 Mala Chalok
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE