ভোট এসে গেল।
আমাদের মত লোকজন হচ্ছে বাজারু ভোটার। সবজি বাজারে যে রকম আলুটা মুলোটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যাচাই করে ভালটা কেনার দস্তুর, ভোটের বাজারেও তাই। কোন পার্টি কী রকমভাবে সরকার চালিয়েছে, চালাচ্ছে দেখে শুনে ভোট দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে কিনা, প্রতিবারই পচা আলু বা কানা বেগুন কিনে কেনাকাটা শেষ হয়- এই যা দুঃখের।
সুতরাং ভাবার এবং বোঝার চেষ্টা করছি, এই সরকারের কাজকর্ম কেমন দেখলাম। মনে পড়ে, আগের বার যে দিন বিধানসভা নির্বাচনের ফল বার হল- অফিস থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নেমেছি, পাড়ার মোড়ে সবুজ আবির সহ উল্লাস। এক অপরিচিত প্রৌঢ় ভদ্রলোক ভিড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে এসে আমার হাতে একটা চকোলেট গুঁজে দিয়ে বললেন “মা-মাটি-মানুষ”। আমিও কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে তাঁকে একটা ভ্যাবলা মতো হাসি ফিরিয়ে দিলাম। সত্যি বলতে কি, এক ধরনের ইতিবাচক অনুভূতি হয়েছিল। সুকুমার রায়ের গল্পের ব্যাঙেরা বক রাজা পেয়ে যে রকম খুশি হয়ে গিয়েছিল অনেকটা সেই রকম।
তার কদিন পরেই শুনলাম আমাদের এলাকার সরকারি হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন এবং একজন বড় ডাক্তারবাবুকে ধমকে গেছেন। এটা আমার কাছে নতুন। প্রতিটা অফিসকাছারি বা হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং গিয়ে তদারক করলে কাজকর্মের সুরাহা হতে পারে কি না, বা ডাক্তারকে বকাঝকা করা মুখ্যমন্ত্রীর কাজের মধ্যে পড়ে কিনা, এই সব তুলনামুলক চিন্তায় ভাবিত রইলাম কিছু দিন।
আরও পড়ুন-কত দিন আমরা সহ্য করব এই অন্যায়?
আরও ক’দিন পর। শুনলাম ব্যঙ্গচিত্র আঁকার অপরাধে জনৈক অধ্যাপক গ্রেফতার হয়েছেন। তার পর শুনলাম আঁকেননি, ইমেল পাঠিয়েছেন। তার পর শুনলাম, ঠিক ব্যঙ্গচিত্র না, কম্পিউটারের কারসাজি করা ছবি। কিন্তু এই খবর পেয়ে সুকুমার রায়ের ব্যাঙদের মতোই আমার প্রথম বারের ইতিবাচক অনুভূতি তিন পর্দা নেমে গেল। আমি এবং আমার পরিচিত মহলে অনেকের কাছেই ব্যঙ্গচিত্র বা ফটোশপ করা ছবি আঁকা, পাঠানো বা পোস্ট করা জলভাত। হ্যাঁ, অবশ্যই শালীনতার সীমা অতিক্রম না করে। কেউ কখনও ভাবিইনি এসব কাজের জন্য কাউকে পুলিশ ধরতে পারে! কে জানে, অজান্তে এমন কিছু হয়তো হামেশাই করছি যেটা আমার কাছে অপরাধ নয়, কিন্তু পুলিশের চোখে মারাত্মক অন্যায়। কবে কখন সন্ধে ছ’টার পর বিনা টিকিটে হাঁচলে পরে পেয়াদে এসে পাকড়ে ধরবে সেই চিন্তা যে গেড়ে বসল সে এখনও যায়নি।
মিথ্যে বলব না, তার পর থেকে একটা ভয় ভিতরে ঢুকে গেছে। টিভির একটা অনুষ্ঠানে যে রকমভাবে এক ছাত্রীকে ‘মাওবাদী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাতে বারবার মনে হয়েছে, কাল আমাকেও কেউ ‘মাওবাদী’, বা ‘পাপাঙ্গুল’ বলে দেগে দিয়ে হেনস্থা করতেই পারে। আগের সরকারের আমলেও হয়তো এই ভয়গুলো ছিল, কিন্তু আমার মত পাতি ভোটারের মনে তখনও পর্যন্ত এতটা ছায়া ফেলেনি। ভয়গুলো হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল এই আমলেই।
অতঃপর এল সারদা। আমাদের পাড়ার সেলুনের কমলদা ছিলেন তার এজেন্ট। তিনি সেই যে গা ঢাকা দিলেন, তারপর থেকে অনেক দিন চুল কাটার জন্য বেপাড়ায় যেতে হয়েছে। সরকার একটু যত্ন করে নজরদারি চালালে এমনটা হত না, এই ভেবে সরকারের এক পয়েন্ট মনে মনে কেটে নিয়েছি (তবে কিনা সরকারের তাতে কী আসে যায়)!
ক’দিন আগে পাড়ার মোড়ে শাসকদলের এক সভা থেকে উড়ে আসা বক্তৃতার এক টুকরো ভাবিয়ে তুলেছে “শান্তি ভঙ্গ করলে চামড়া ছাড়িয়ে নেব।” চামড়া ছাড়িয়ে শান্তিরক্ষা করার এই ভাবনাটা নতুন। তবে একটু ভয় ভয় করে।
রাস্তাঘাট, জলনিকাশী ইত্যাদির কথা যদি বলা যায়, আমাদের এলাকায় ত্রিফলা আলো বসেছে এন্তার। দেখতে মন্দ লাগছে না। আলো বসাতে গিয়ে টাকা পয়সার অনিয়ম কী হয়েছে সেই নিয়ে সবাই খবরের কাগজে পড়েছেন এবং নানা মুনির নানা মত।
সে যাক গে। সরকারের কোনও কাজই কি আর ভাল লাগে নি? এই তো সেদিন এক আত্মীয়ের মৃত্যুর পর শ্মশান যেতে হল। দিব্যি ঝাঁ চকচকে শ্মশান হয়েছে। পাঁচ সাত বছর আগের সেই পুতিগন্ধময় গাঁজাখোর অধ্যুষিত শ্মশানের ভোলবদল মন্দ লাগল না।
আরও হয়েছে। মোড়ের মাথায় বড় জলাশয় ঘিরে বেঞ্চ বসেছে, ত্রিফলা আলো বসেছে। টিনের তৈরি সুর্যমুখী ফুল দিয়ে কী সুন্দর সাজানো হয়েছে! বেশ লাগে দেখতে।
শুধু টিনের ফুলগাছকে জায়গা করে দিতে সত্যিকারের বেশ কিছু গাছ কাটা পড়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy