Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪

ওঁর চারপাশের লোকেরা সব এক একটা ডাকাত

নারদা নিউজের প্রধান ম্যাথু স্যামুয়েলের সঙ্গে আইপিএস অফিসার এসএমএইচ মির্জার কথোপকথনের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল গত কাল। আজ শেষ পর্ব। সঙ্গে রইল মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ম্যাথুর কথোপকথনের অংশ। গোপন ক্যামেরায় বন্দি এই কথোপকথনের সত্যতা অবশ্য আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।কখন যে কী করে দেন, কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। কিন্তু যাকে পছন্দ করেন, তার জন্য সব কিছু করে দেবেন।

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:১৬
Share: Save:

ম্যাথু: মমতাদি আপনাকে খুব পছন্দ করেন, তাই না?

মির্জা: এমনিতে উনি খুব খামখেয়ালি।

ম্যাথু: খামখেয়ালি?

মির্জা: খুবই। কখন যে কী করে দেন, কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। কিন্তু যাকে পছন্দ করেন, তার জন্য সব কিছু করে দেবেন।

ম্যাথু: সব কিছু?

মির্জা: নন্দীগ্রামে যখন ঝামেলা শুরু হয়, আমি ওখানে। উনি প্রায়ই আসতেন। মুকুলদা সেই সময়ে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সেটা... ২০০৭। অক্টোবরের ২৮ তারিখ। মুকুলদা বলেন, ‘দিদি, এ হল মির্জাভাই। পুলিশে যোগ দেবার আগে থেকে একে আমি চিনি। এর মতো কিছু অফিসার আপনাকে পছন্দ করে বলেই আপনি আজ এখানে।’ নন্দীগ্রামে আমরা যা করেছি না! সে সব পরে আর এক দিন আপনাকে বলব। নন্দীগ্রামের পরে‌ আমি বদলি হই অ্যাডিশনাল এসপি বারাসত। আমার হাতে তখন ২০টা বিধানসভা এলাকা।

ম্যাথু: ২০টা!

মির্জা: হ্যাঁ। ২০টা। ডিআইজি-র মতো ছিল আমার পাওয়ার। এসপি বলেছিলেন, নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগটা তুমিই করবে। তার পরে প্রমোশন পেয়ে গেলাম সিআইডি-তে। তখন মা-বাবা খুব টেনশনে থাকতেন। আমারও মুড ভাল ছিল না। এক দিন সোজা সিএম-এর সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম।

বললেন, মির্জা তোমায় বর্ধমানে পাঠাতে চাই

ম্যাথু: দিদি তখন সিএম?

মির্জা: হ্যাঁ। ২০১১-র মে-তে উনি সিএম হয়েছেন, আর এটা তখন এই অগস্ট হবে। তার পরে জানুয়ারিতে উনি ডিজি-কে বললেন, ‘মির্জাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।’ আমি তখন প্লেন ড্রেসে টেবিলে বসে কাজ করছি। ব্লেজার নেই, টাই নেই। ডিজিকে বললাম, এই অবস্থায় যাব, না পরে? ডিজি বললেন, এ ভাবেই যাও। দেরি করলে উনি আমাকে গুলি করে দেবেন!

ম্যাথু: হা হা হা...

মির্জা: তো, আমি গেলাম। বললেন, বোসো, চা খাও। তার পরে বললেন, মির্জা, তোমাকে বর্ধমানে পাঠাতে চাই। আমি বললাম, আপনি যখন চাইছেন, ঠিক আছে। তার পরে বললেন, এই করতে হবে, ওই করতে হবে। সামনে পুরসভার ভোট, পঞ্চায়েতের ভোট। আমি সব করলাম। চুপচাপ। তিনি খুশি।

ম্যাথু: তিনি খুব খুশি!

মির্জা: খুব... খুউব। কোনও প্রবলেম নেই। তার পরেও কয়েক বার আমাকে রাইটার্সে ডেকে পাঠিয়েছেন। এটা করো, ওটা করো বলেছেন। আমিও করে দিই।

ম্যাথু: উনি তো খুব সাধারণ। চটি পরেন, সাদা কাপড় পরেন।

মির্জা: বছর তিনেক হল, কালীঘাটের বাড়িতে এসি বসিয়েছেন। আগে এসি-ও তো ছিল না।

ম্যাথু: আচ্ছা!

মির্জা: তবে ওঁর চার পাশের লোকেরা পয়সা করে নিয়েছে। ওরা সব এক একটা ডাকাত। মুকুলদার যখন যা লাগে আমাকে বলেন। আমি অলরেডি ৬০ কোটি তুলে দিয়েছি ওঁকে।

ম্যাথু: ষাআআট?

মির্জা: এটা-ওটা ছাড়াও কম করে, কম করে ৬০ কোটি।

মন্ত্রী আমার পায়ে হাত দেয়, ভাবতে পারছেন?

মির্জা: কালকের ওই মিটিংটায় যে লোক হবে না, সেটাও আমি জানিয়েছিলাম।... ওই মন্ত্রীটার বারোটা বাজবে। বাজবেই...

ম্যাথু: তাই নাকি?

মির্জা: সিএম আমাকে অনেক বার জিগ্যেস করেছেন, স্বপন দেবনাথ কেমন কাজ করছে? আমি বলি— ভাল। যা বলি তাই করে। স্বপনও সেটা জানে। আমার সঙ্গে দেখা হলে তাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। হা হা হা। মন্ত্রী আমার পায়ে হাত দেয়... ভাবতে পারছেন?

ম্যাথু: লোকসভা ভোট নিয়ে কী বুঝছেন?

মির্জা: তৃণমূল ৩৫ থেকে ৩৭টা পাচ্ছেই।

ম্যাথু: বিজেপি-কে সমর্থন করবে?

মির্জা: পেছন থেকে তো করবেই। আড়াল থেকে, ইস্যু ধরে ধরে।

ম্যাথু: ইস্যু অনুযায়ী সাপোর্ট?

মির্জা: নিশ্চয়ই। এখনও ফাইনাল কথা হয়নি। ভোটের পর ওরা বসবে। তখন এটাই সিদ্ধান্ত নেবে। নিতেই হবে।

ম্যাথু: কিন্তু মোদীকে সরাসরি সাপোর্ট করবে না?

মির্জা: মোদী পাবে ১৫০ থেকে ১৬০টা। বড় জোর। আপনি আসানসোলে আসুন। সেখানে আর একটা মন্ত্রী আছে। মলয় ঘটক। সে নোংরা খেলা খেলছে। মুকুলদাকেও বলেছি। দিন কয়েক আগে একটা মহামিছিল ছিল। সে জন্য ব্যবসাদারদের থেকে ১২ লাখ তুলেছে। একটা পয়সা খরচ করেনি।

ম্যাথু: মুকুলদা তো এখন সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড, তাই না?

মির্জা: অভিষেককে তোলা হচ্ছে। কিন্তু ও বাচ্চা ছেলে। সামলাতে পারবে না।... আসলে নানা রকম লবি চলে। মুকুলদা প্রপার কলকাতার লোক নন।... কলকাতার লবি তাঁকে চায় না। এই তো, ১৯৯৬-এ আমি তখন মুর্শিদাবাদে। ইকবাল ভাই ফোন করে বলেন—‌ মির্জাভাই, কে প্রার্থী হচ্ছে? বললাম, আমি কী করে বলব! বলে, আপনার কাছে সব খবর আছে। আমি যে মুকুলদার লোক, সেটা জানে তো, তাই।

ম্যাথু: কাল আপনি কলকাতায় আছেন?

মির্জা: দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে বর্ধমান যাব।

ম্যাথু: আমি সকালে একটু আরামবাগ যাব। বিকেলেই ফিরব। তার পর আপনি অভিষেকের সঙ্গে মিটিংটা করিয়ে দিন।

মির্জা: ঠিক আছে। তা হলে সন্ধ্যায় হোক।... কাল বর্ধমানে যাব। সেখানে তিন-চার দিন থাকতে হবে।

ম্যাথু: কাল মিটিংটা হয়ে যাক। তার পরে পরশু আমি বর্ধমান যাচ্ছি। আপনি একটু গেস্টহাউসের বুকিংটা যদি করে রাখেন...

মির্জা: ফাইন। রবিবার আসুন। আমার বাংলো ঘুরে যাবেন। গেস্টহাউস বুক করে রাখব। ভাল বোতল থাকবে।

(একটা ফোন আসে। মির্জা ফোনে বলেন, ‘আমি অলওয়েজ চিয়ার। নো প্রবলেম’)

ম্যাথু: রবিবার ওই মিডিয়া হাউসের লোকটা কি থাকবে, যারা চ্যানে‌ল করতে চায়?

মির্জা: ডেকে নেব। আমার বাংলোর পাশে সার্কিট হাউস। আজ সকালেও সেখানে অবজার্ভাররা প্রেস কনফারেন্স করেছে। প্রেসের লোকেরা সকালেই আমাকে ফোন করে বলে, আপনি কি বর্ধমানে? বললাম, না। বলল, আপনি থাকলে বাংলোয় এসে একটু চা খেয়ে যেতাম। আমি বললাম, আমি না-থাকলেও ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। চলে আসুন। তারা এসে চা খেয়ে গিয়েছে। লোকাল মিডিয়াকে সব সময় কব্জায় রাখতে হয়, বুঝলেন তো।

ম্যাথু: ঠিক।

মির্জা: কাল অভিষেকের সঙ্গে মিটিংটা তো হচ্ছেই। আর একটা কাজ আপনাকে করতে হবে। আমার রিকোয়েস্ট।

ম্যাথু: বলুন।

মির্জা: শঙ্কু পণ্ডার সঙ্গেও একটু বসে আসবেন। ও-ই অভিষেকের সঙ্গে মিটিংটা করিয়ে দিচ্ছে।

ম্যাথু: ফাইন।

মির্জা: সে সব সময়ে ওদের চার পাশে থাকে। সিএম-এর, অভিষেকের। বেশি নয়, ওকে এক লাখ ধরিয়ে দেবেন। যথেষ্ট। আমি ফোন করে দিচ্ছি। ও আপনার হোটেলে চলে আসবে।

ম্যাথু: সৌগত রায়েরটা একটু বলে দেবেন।

মির্জা: এখনই করছি।

(মোবাইলে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করতে থাকেন)

ম্যাথু: দীনেশের কেসটা একটু গড়বড়ে হয়ে গেছে, তাই না?

মির্জা: হা হা হা। একটু গড়বড় হয়ে গিয়েছে?

ম্যাথু: সুদীপ? সেটাও নাকি গড়বড় কেস?

মির্জা: সুদীপ ফাইন। সেটিং। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কোনও গড়বড় নেই।

(মির্জা ফোন পেয়ে যান। বাংলায় বলেন)

মির্জা: তুমি কোথায়? বলছি কী— একটা বিষয় নিয়ে সৌগত রায়ের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। নিজে ফোন করব, না তুমি বলে দেবে? ওঁর ভালর জন্যই বলতে চাই। তুমি বলে দাও, ওঁর জন্য একটা স্পনসর করে দিতে চাই। তুমি কি বলে দেবে? না না... দাদা তো বলেছে। বলেছে বলেই তো শুভেন্দু অধিকারীকে করিয়ে দিয়েছি, কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে করিয়ে দিয়েছি, তোমার সুলতান আহমেদকে করিয়ে দিয়েছি। মদনদা নেই (প্রার্থী নন), কিন্তু মদনদাকেও করিয়ে দিয়েছি। অভিষেককে করিয়ে দেব। ভাবছি সৌগতদা— মানে সৌগত রায়কেও করিয়ে দেব। তুমি বলে দাও, আমি পাঁচ মিনিট পরে ফোন করছি। বলো, স্পনসরের সেই ব্যাপারটা নিয়ে মির্জাসাহেব ফোন করবে। যা বলার ওঁকেই বলব। বলে জানাও। ফিড ব্যাক দাও। ফিড ব্যাক দাও।

(একটু পরে ফের মির্জার ফোন বেজে ওঠে। উনি ‘হুঁ-হাঁ’ করে রেখে দেন)

মির্জা: বলল যে, সৌগত রায়কে পরে ফোন করতে হবে। উনি এখন বক্তৃতা দিচ্ছেন।

ম্যাথু: দিদির পরে কারা কারা পাওয়ারফুল?

মির্জা: প্রথমে মুকুল রায়। তার পরে সুব্রত বক্সী। অবশ্যই তার সঙ্গে বসবেন।

ম্যাথু: দাঁড়ান, আমি একটু লিখে নিই।

মির্জা: বক্সীকে আমি এখনই ফোন করছি। (ফোন করার চেষ্টা করেন। ফোন ব্যস্ত) এখন ভোটের সময় তো, সবার লাইন ব্যস্ত। মুকুলদা, সুব্রত বক্সীর পরে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ধুতিওয়ালা। পঞ্চায়েত মন্ত্রী।

ম্যাথু: ওঁর সঙ্গে দেখা করেছি। খুব হাসিখুশি লোক।

মির্জা: হ্যাঁ। ওঁর ভোকাল কর্ডে কিছু প্রবলেম আছে। কথা বুঝতে অসুবিধা হয়।

কাজের লোক সবাই, নিয়ে কাজটা করে দেন।

ম্যাথু: এঁরা সবাই করাপ্ট, না? সবাই টাকা নেন?

মির্জা: হ্যাঁ। এদের সবার সঙ্গে দেখা করবেন। তবে কাজের লোক সবাই। (টাকা) নিয়ে কাজটাও করে দেন।

ম্যাথু: সুব্রতদা খুব মজা করে কথা বলেন।

মির্জা: এক বার আমার বাড়িতে এসে বলেন— বিরিয়ানি কই? চাল-টাল কিনে দিলাম। আমার স্ত্রী রান্না করলেন। আমি বললাম, যাও, সুব্রতদাকে দিয়ে এস। উনি বললেন, এখন নয়। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বেঁধে দিয়ে দাও। রাস্তায় খাব। হা হা হা... প্যাক করে গাড়িতে তুলে দিলাম। মটন চাঁপ আর বিরিয়ানি। আপনি রবিবার আসুন আমার বাংলোয়, বউয়ের রাঁধা বিরিয়ানি খেয়ে যাবেন।

(মির্জা আবার ফোন করেন। পান না।)

উনি হয়তো বলবেন, ওর হাতে দিয়ে দিন

ম্যাথু: এখন সবাই ব্যস্ত।

মির্জা: আপনি কাল অভিষেকের সঙ্গে দেখা করছেন। শঙ্কুর সঙ্গেও। সৌগতদারটাও হয়ে যাবে। আর সুব্রত বক্সীর সঙ্গে অবশ্যই দেখা করবেন।

ম্যাথু: ওঁকেও টাকা দেব তো?

মির্জা: উনি হয়তো আর কাউকে দেখিয়ে বলবেন, ওর হাতে দিয়ে দিন। দিয়ে দেবেন, ব্যাস।

ম্যাথু: ওঁর সামনে, ওঁর কথায় আর কারও হাতে টাকা দিতে আমার কোনও প্রবলেম নেই। প্রথম বার তো। আমার থেকে হাত পেতে টাকা নিতে হয়তো লজ্জা পাবেন। তার পরে তো আবার আসছিই। এ ভাবেই তো সম্পর্ক তৈরি হয়।

মির্জা: ঠিক।

ম্যাথু: আমার বস শিখিয়ে দিয়েছেন, প্রথমেই হাতে টাকা ধরিয়ে দাও। পরে তারা মনে রাখবে— তুমি এক দিন তাদের সাহায্য করেছ। এ ভাবেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

মির্জা: ঠিকই তো। আমি সব বলে রাখব।

ম্যাথু: কোনও সমস্যা নেই। এরা এমনিতে সবাই সৎ লোক। শুধু একটু টাকা খায় এই যা। এটাই আমাদের ভারতবর্ষ। হা হা হা।

মির্জা: হা হা হা...

ম্যাথু: কাল বস আমাকে ফোন করে বারবার বলে দিয়েছে, অভিষেকের সঙ্গে বসতে ভুলবে না। উনিই তো ফিউচার, না!

মির্জা: ঠিক।

ম্যাথু: আপনি যদি বাইরে কোথাও ট্যুরে যেতে চান, বলবেন।

মির্জা: নিশ্চয়ই বলব।...

ম্যাথু: দিদি তো প্লেনে চড়ে এ দিক-ও দিক যান, তাই না? কাদের প্লেন?

মির্জা: রাজহংস। সেটাও তো জোগাড় হয়েছে অনেক দেরিতে। তবে চাইলে ওরা দিয়ে দেয়।

ম্যাথু: এটা কাদের? কে দেয় এটা?

মির্জা: বম্বের কারও। প্রাইভেট। আসলে সবাই তো জানে, টিএমসি থার্ড মেজর পাওয়ার হতে চলেছে, তাই এমনিই দিয়ে দেয়।...

(এর একটু পরে একটা ফোন আসতেই মির্জা হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়েন। বলেন, যেতে হবে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE