Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘মহেঞ্জোদারো’য় ঘোড়দৌড়, তাতে কী এল-গেল!

সিনেমাটি এখনও মুক্তি পায়নি। কিন্তু তার পোস্টার আর ট্রেলার দেখেই বিতর্ক একেবারে তুঙ্গে! বাঁকা চোখে দেখলেন বিতান সিকদারসিনেমাটি এখনও মুক্তি পায়নি। কিন্তু তার পোস্টার আর ট্রেলার দেখেই বিতর্ক একেবারে তুঙ্গে! বাঁকা চোখে দেখলেন বিতান সিকদার

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ২০:৩৮
Share: Save:

পরিতোষ গোয়াড়েকর নির্মিত ‘মহেঞ্জো দারো’ ছবির ট্রেলার নিয়ে সম্প্রতি বেশ গোল দেখা দিয়েছে। কী, না পরিতোষবাবু তার সিনেমায় ঘোড়দৌড় করিয়ে দিয়েছেন। মহেঞ্জো দারোতে ঘোড়া কোথা থেকে এল – ব্যস, গেল গেল রব! সোস্যাল মিডিয়ায় এর প্রতিবাদ দেখে মনে হচ্ছে ভারতের সার্বভৌমত্বই বুঝি খর্ব হয়ে পড়েছে।

ঘোড়া ছিল কী ছিল না, সে তর্ক না হয় তোলা থাক। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ইতিহাসের কোনও বিকৃতি ঘটেই থাকে, সেই দায় পরিতোষবাবুর, না আমার? আজ হঠাৎ করে বিপ্লব করছি— এ যাবৎ কি আমি ইতিহাস বই পড়ে সমস্ত ঐতিহাসিক বায়োস্কোপ দেখতে গেছি, নাকি পরিতোষবাবুর ইতিহাস বিকৃতির উদাহরণ নতুন?

দু’হাজার আট সালে নির্মিত ‘যোধা আকবর’ নামক যে ছায়াছবিতে তিনি যোধাবাঈ নাম্নী হিন্দু রাজপুত রমণীকে নিয়ে এলেন, তার ঐতিহাসিক ভিত্তিটি কী? না ‘আকবরনামা’, না ‘তুজক-ই-জাহাঙ্গিরি’– কোনওটাতেই যোধাবাঈ বলে কারোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাতে কী? কবে আমি মূল ধারার ভারতীয় ছবিতে বিষয়বস্তুর অথেন্টিসিটি খুঁজেছি?

আরও পড়ুন: ৩ মিনিটের ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ সফর চমকে দেবে আপনাকে

আর আজ হঠাৎ পরিতোষবাবুই বা কেন? উনিশশো ষাট সালে জে আসিফ নির্মিত ‘মুঘল-এ-আজম’-এ কী দেখান হয়েছিল? আনারকলির সঙ্গে জাহাঙ্গিরের প্রেম নিয়ে বচসা। যোধাবাঈ সেখানেও ছিলেন, আকবরের পাশে বসে আনারকলির নাচ দেখছেন। এক যোধায় রক্ষে নেই, তায় আনারকলি দোসর। উল্লেখ্য এই, আনারকলি নামক জাহাঙ্গিরের কোনও প্রেমিকার উল্লেখও কিন্তু ঐতিহাসিক দস্তাবেজ-এ পাওয়া যাচ্ছে না। তা, তখন কি আমি বিপ্লব করেছিলাম?

আরে মশাই, অ্যারিস্টটল পড়ুন। নাটক কী ঘটেছিল সেটা বলে না, কী ঘটতে পারত তা তুলে ধরে। সেই প্রব্যাবিলিটির থিয়োরি ধরে যে কোনও গল্পকে মাখিয়ে পাকিয়ে তুলতে পারলেই আমি গিলে নেব। তবে হ্যাঁ, মাখা যেন আমার মনোমত হয়!

আমি অতিসাধারণ দর্শক। অতিরিক্ত মেলোড্রামা তথা ম্যানারিজম দেখতে দেখতে মূল ধারার ভারতীয় ছায়াছবি আমার কাছে শুধুমাত্র একটা মেক-বিলিফ জগৎ হয়ে রয়ে গেছে। সোজা ভাষায়, বায়োস্কোপে এমন কিছু থাকতে হবে যা দেখে আমি আমার সমস্ত অবদমিত তথা অপূর্ণ ইচ্ছে মিটিয়ে নিতে পারি।

তা, সে সব তো পরিতোষবাবু দিচ্ছেন। ‘যোধা আকবর’-এ কার্তিক রোশনের মাংসপেশি সঞ্চালনও আছে (যদিও জানি না আকবরের চেহারায় অমন গ্রিক ভাস্কর্যের আদল ছিল কি না) আবার যোধাবাঈয়ের ভূমিকায় ষড়ৈশর্য রাইয়ের যৌন আবেদনও আছে। তায় মাখো মাখো প্রেম। আর কী চাই?

উনিশশো পঁচাত্তর সালে মহেশ সিপ্পি তাঁর ‘শোলে’ ছবিতে বীরুর ভূমিকায় বরেন্দ্রকে নিয়ে বলিয়েছিলেন, “ইশ শ্‌টোরি মে ইমোশান হ্যায়, ড্রামা হ্যায়, ট্র্যাজিডি হ্যায়...” – এটাই আমার মতো আম-দর্শকের চাহিদা। সেটা মিটে গেলে গুলি মার ‘মহেঞ্জো দারো’র ঘোড়াকে।

দুষ্টু লোকে নাকি এ-ও বলছে যে ‘মহেঞ্জো দারো’র নবাগতা নায়িকা এমন পোশাক পরেছেন, তাতে তাকে সিন্ধু সভ্যতার রমণী মনে হওয়ার থেকে বেশি অ্যাঞ্জেলিনা জোলি মনে হচ্ছে। মোলো যা! আরে আমি তো তাই দেখতেই ছবিঘরে যাব। গ্ল্যামার কোশেন্টে যে জোলি কোনও এক প্রাচীন সভ্যতার নারীর থেকে অনেক বেশি আবেদনময়ী, এ কি আর আমি জানি না নাকি পরিতোষবাবু জানেন না?

এই মূল ধারার সিনেমা আমার কাছে অপূর্ণ তথা অবদমিত ইচ্ছাপূরণের একটা মাধ্যম। পাশের পাড়ার মনোরঞ্জন সে দিন যখন খবরের কাগজের স্ট্যান্ডে আমায় পিটিয়েছিল, তখন কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু অমিত আভাধারী বচ্চন যখন ভিলেন ঠ্যাঙাচ্ছে, তখন কিছু ক্ষণের জন্য হলেও অমিতের জায়গায় নিজেকে আর ভিলেনের জায়গায় মনোরঞ্জনকে ভাবতে আমার বেশ ভালই লাগে। অমিত আমায় জীবনে এগোবার অনুপ্রেরণা যোগায়।

নাচ, গান, প্রেম, অ্যাকশন, মেলোড্রামা তথা ম্যানারিজম— আমি ‘মুভি’ বলতে এই বুঝি। ঐতিহাসিক যাথার্থ্য নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত না হয়ে আমি এর আগে এ ধরনের বহু সিনেমাকে ব্লকবাস্টার বানিয়ে দিয়েছি।

আর শুধু ইতিহাস কেন, সিনেমা সাহিত্যের সঙ্গেই বা কী এমন আপোষ করেছে? ধনঞ্জয় ভনশালি বিশ্ববন্দিত পরিচালক। তিনি শরৎবাবুর ‘দেবদাস’ নিয়ে ছবি বানিয়েছিলেন। ওহ্‌, নায়কের সে কী আবেদন। বিশাল বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে তিনি থাকেন, তায় তার তেমন তেমন সেট। শরৎবাবু দেবদাসকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বানালেও ছবিতে তো আর তা দেখান যায় না। দুষ্টজনে বলে, ভনশালি নাকি প্রথমে সেট-টা বানিয়ে নেন। তারপর তাতে চরিত্র তথা গল্প গুঁজে দেন। তাতে কী রক্ষা পেল, আর কী গেল আমার সেটা ভাবতে বয়ে গেছে। আমার অতিরঞ্জিত একটা নাটক হলেই হল “যিসমে ইমোশান হ্যায়, ড্রামা হ্যায়, ট্র্যাজিডি হ্যায়...”

এঁরা সব বাঘা বাঘা পরিচালক। এঁরা হিট দেন।

আমি চিরকাল রূপোলি পর্দায় লার্জার দ্যান লাইফ একটা ইমেজ খুঁজে ফিরেছি। যুবরাজ কপূর ছেঁড়া ছাতার নীচে ‘প্যায়ার হুয়া ইক্‌রার হুয়া’ গেয়েছিলেন বলে আমি রোম্যান্স বুঝেছিলাম। আমার বয়ে গেছে ওঁকে ‘জাগতে রহো’ ছবিতে নন-গ্ল্যামারাইজড্‌ দেহাতি চরিত্রে দেখতে।

সেই মহেঞ্জো দারোর সময় থেকে আমার এই মানসিকতা অটল। দু’হাজার এক সালে যখন ‘অশোকা’ মুক্তি পেল, তখন কি আমি সম্রাট অশোকের জীবনদর্শন দেখতে গেছিলাম? না, আমি ঝাড়ফুঁক খান-এর সেই হৃদয়বিদারক অভিনয় দেখতে গেছিলাম, এবং তাঁর আদলে অশোককে কল্পনা করতে গেছিলাম। নক্ষত্রই ধ্রুব। এই নক্ষত্ররাজিই আমাদের ছোটবেলা থেকে ‘কী রূপে বাঁচিতে হয়, চলিতে হয় তথা বলিতে হয়’ শিখিয়ে এসেছেন। ঝাড়ফুঁক খান-এর কাছ থেকেই শিখেছি কী ভাবে ফোন তুলে অন্যের প্রেমিকাকে বলতে হয়, “ক-ক-ক-ক-ক-কেমন আছ?”

তারপর জলপান খান। আমার ‘ভাই’। ছবির বিষয়বস্তু যাই হোক, প্রতি বছর ঈদ এলে আমি ‘ভাই’-এর সিনেমা দেখতে যাই। দৃশ্যপট যাই হোক, ‘ভাই’ কারণে-অকারণে জামা খুলে ফেলে। আর আমি সিটি বাজাই। ‘ভাই’ যা করবে, তাই হিট। ‘ভাই’ ঘোড়া চড়লেও হিট, জলহস্তির পিঠে চাপলেও হিট।

ব্যতিক্রম আছে, যেমন সত্যজিৎ রায়। চালে কাঁকড়। উনিশশো সাতাত্তরে বানিয়েছিলেন ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে মুন্সি প্রেমচাঁদের গল্প। যেমন ইতিহাসের ডিটেলিং, তেমনই অতিরঞ্জকতা তথা ম্যানারিজম বাদ দিয়ে সঞ্জীব কুমারের অভিনয়। চলেনি। কেন চালাব? ওখানে সঞ্জীব কুমারকে সঞ্জীব কুমার মনে না হয়ে মীরজা সাজ্জাদ আলি মনে হয়েছে যে।

তাই, ইতিহাস ভুগোলের তথা সমসাময়িক সমাজের নিকুচি করে যারা আমাদের ম্যানারিজম ও চেনা ছক দিয়ে মূলত ‘এন্টারটেইন’ করছেন, তাঁরাই শাশ্বত। এ নিয়ে আপত্তি চলবে না। আমিই সিনেমা নামক আর্টকে শুধুমাত্র ইন্ডাস্ট্রির জায়গায় নিয়ে গেছি, যেখানে নায়ক ভুরু তুলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “আই অ্যাম দ্য ইন্ডাস্ট্রি!” আর আমি ভাবি— ওহ্‌, কী অভিনয়!

এই ব্যবসা আমাদের সবার গুরু— একশো কোটির বাজার, একটা অর্থনৈতিক আঙ্গিক যা কি না সর্বগ্রাসী। রায় সাহেবেরই ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’তে রায় বাহাদুরের সংলাপ মনে পড়ে যায়। ছবি বিশ্বাস এক বেকারকে বলছেন, ‘‘একটা অকেজো আনডিজার্ভিং লোকের চাকরি হলে তার পরিবার হয়তো খেয়েপরে বাঁচতে পারে। কিন্তু, একটা বড় অফিসের একটা গোটা ডিপার্টমেন্ট যে ছারখার হয়ে যাবে তার ব্যবস্থা কী করবে তুমি?’’

এটা কি পারফর্মিং আর্টসকেও বলা? অভিনয়ের নামে শুধুমাত্র ম্যানারিজমকে পাথেয় করে এবং গল্পের নামে সেই এক মোটা দাগের ‘ইমোশন’কে কাজে লাগিয়ে যারা একের পর এক একশো কোটির ছবি বানাচ্ছে, তারা আদপে সিনেমা ব্যাপারটাকেই কি ছারখার করে দিচ্ছেন? জানি না, জানার দরকারও নেই!

আমরা ‘নায়ক’-এর সেই অরিন্দম মুখার্জির ‘বাজার’টাকে ঠিক রেখে দেব। যখন কোনও ‘আধুনিকা’ প্রশ্ন তুলবে, “শুধু খেললে তো কথা ছিল না, চ্যাম্পিয়ন। টেনিস চ্যাম্পিয়ন, সাঁতার চ্যাম্পিয়ন, নাচ জানে, গান জানে প্রগতিশীল, এমএ তে ফার্স্ট ক্লাস, দারুণ প্রেমিক— আচ্ছা বলুন তো, এত সব বিশ্বাস হয়?” তখন বলব, অবিশ্বাস্য যা দেখাবেন আমি মেনে নেব। আমি ইমেজ বুঝি, যাকে দেশের পার্লামেন্টেও বসানো যায়। সেই নক্ষত্র হয়তো আড়ালে বলেন তাঁর অসহায়তার কথা, “আমি রাজনীতির কী বুঝি”। আমি দেখি ইমেজ। তুমি ভোট চাইতে এসে গুরু একবার একটু নেচে দিও, “ছাগলু ডান্স ডান্স ডান্স!!!”

তা হলেই হিট!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mahenjo daro bollywood movie
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE