‘বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী’ প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হচ্ছে নজর। —নিজস্ব চিত্র।
নাটকের মুখ্য চরিত্র যদি গাঁ-ঘরের পাশের বাড়ির ধর্ষিতা মেয়েটির ছায়া অবলম্বনে নির্মাণ হয়, নাট্য-বিষয় যদি সালিশি সভায় রাতভর গণধর্ষণ হয়, চমকে উঠতে হয় বৈ কি! তেমন চমক নিয়েই নতুন নাট্য-প্রযোজনা করেছে ‘বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী’।
লাভপুরে, আদিবাসী বালিকার গণধর্ষণের ঘটনা অবলম্বনে বারোটি চরিত্রনির্ভর ‘নজর’ নাটক মঞ্চস্থ করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছে নাট্যদলটি। নাটকটি লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন উজ্বল মুখোপাধ্যায়।
উজ্বল বলেন, ‘‘লাভপুরের ঘটনা সেই সময়ে আমাদের খুব নাড়িয়ে দিয়েছিল। এর পরেও, রাজ্যে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা শিরোনামে আসছে। প্রতিবাদ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু অপরাধ থেমে থাকেনি। লাভপুরের যে ঘটনা, তাতে একটি সম্প্রদায় ‘সম্মান’ লঙ্ঘনের দায়ে সালিশি সভা বসায়। গণধর্ষণের ছাড়পত্র দেওয়ার যে নিদর্শন ঘটে, তেমন এ রাজ্যে কখনও শোনা যায়নি।’’ নাটকে আদিবাসী সমাজে নারীর সেই অসহায় অবস্থানই তুলে ধরা হয়েছে। লাভপুরের মানুষ, কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডাইনী’ গল্পের স্বর্ণ চরিত্র এ নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের মা।
মুখতারন মাইয়ের ভয়াবহ স্মৃতি উস্কে দিয়ে গত বছর ২২ জানুয়ারি সিউড়ি সদর হাসপাতালের বেডে শুয়ে নির্যাতিতা জানিয়েছিল, তাঁর উপরে রাতভর পাশবিক অত্যাচারের কথা। পাকিস্তানের মুজফ্ফরগড়ের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে গিয়েছিল বীরভূমের লাভপুর। ভিন্ জাতের এক যুবকের সঙ্গে সর্ম্পকের অপরাধে লাভপুরের এক গ্রামে প্রেমিক-প্রেমিকা দু’জনকেই প্রথমে সারা রাত গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। পরের দিন তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের গ্রাম, সুবলপুরের সালিশি সভায়। সেখানে গ্রামের মোড়ল মোটা টাকা জরিমানা হাঁকেন। অনাদায়ে নিদান দেন, “টাকা না পেলে তোরা মেয়েটাকে নিয়ে মস্তি করে নে!”
‘‘ভাই-বাপ-দাদার বয়সী ওই লোকগুলো সারা রাত আমার উপরে অত্যাচার করল,”— পরের দিন বলেছিলেন নির্যাতিতা। অভিযুক্ত ওই মোড়ল গ্রাম-সম্পর্কে তাঁর কাকা হন বলে জানিয়ে কুড়ি বছর বয়সী নির্যাতিতা অভিযোগে জানিয়েছিলেন, ‘‘পর পর ১২ জন মিলে, রাতভর ধর্ষণ করল ওরা। নিষেধ শোনেনি কেউ! গরিব মানুষ, টাকা কোথায় পাব?’’
নাটকের ষষ্ঠ দৃশ্যে উজ্বল দেখিয়েছেন শিউরে ওঠার সে রাত।
নাটকে ফুলমনিয়া নামে এক সাঁওতাল যুবতীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে রহমতের। কিন্তু রহমের সঙ্গে ফুলের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় গ্রামের মোড়ল। ঘটনাচক্রে এই মোড়লই স্বর্ণ ডাইনের মেয়ে ফুলমনিকে গ্রামে ফিরিয়ে এনেছিল শহর থেকে। কিন্তু তাকে এড়িয়ে রহমের সঙ্গে সম্পর্কই ফুলের কাল হল। এক দিন সাঁঝবেলা মারাংবুরুর থানে মুনডাঙার বাসিন্দারা ভিড় করে এসেছিল সালিশি শুনতে। গলার শির ফুলিয়ে মোড়ল জানিয়ে দেন— ‘মুনডাঙা মাঝিপাড়ায় দারুণ বিপদ। গাঁয়ে আবার ডান হইচে।’ ঘোষণা করে— সেই ডাইন ‘সন্ন ডানের বিটি ফুলমনিয়া।’ বিধান দেয়, ‘১১ জন মরদ মিলে তুর শরীরটোকে খাবে। সারা রাত ধরে খুবলে খুবলে খাবে। বল কে কে থাকবে!’
ফুলমনির চরিত্রে অভিনয় করছেন অন্বেষা ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘বেহমাই গ্রামে ফুলনদেবীকে গণধর্ষণের কথা পড়েছিলাম। বাড়ির পাশে এমন ঘটবে, ভাবিনি। চরিত্রটি অভিনয় করতে গিয়ে প্রতি শোয়ের শেষে চুপ করে বসে থাকি। ভাবতেও ভয় হয়, মেয়েদের উপর অত্যাচার আর কত দিন চলবে!’’ নাটক শেষ হয় মোড়লের আদেশে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত ফুলমনিয়ার জন্য রহমের নিভৃত অপেক্ষায়। দিন যায়, মাস।
কয়েক মাস আগে, সিউড়ির হোম থেকে সরকারের করে দেওয়া এক চিলতে আশ্রয়ে ফিরেছেন লাভপুরের নির্যাতিতা। তিনি অবশ্য এত কিছুর কথা জানেন না। বেঁচে থাকার মানেটাই তাঁর কাছে আজ অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। দিনের বেশির ভাগ সময়টাই রোদে ঝলসানো দূরের ছাতিফাটা মাঠের দিকে চেয়ে কাটে।
তারাশঙ্কর ‘ডাইনী’ লিখেছিলেন পাঁচের দশকে। যে অশনি সঙ্কেত ‘ডাইনী’ গল্পের শেষে ছিল, ‘নজর’ যেন তারই উত্তর-কথার রেশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy