সোমলতা। ছবি: সুদীপ্ত চন্দ
সোমলতা মানেই ‘তুমি আসবে বলে’ বা গিটার হাতে রবীন্দ্রসংগীত ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’। একটা ছক ভাঙা ইমেজ। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ‘‘সচেতন ভাবে এই ইমেজে নিজেকে মেলে ধরিনি। আমাকে একটা প্রজেক্টের জন্য এই ইমেজে আসতে হয়েছিল। আমার ভাললাগা থেকে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছি। স্টেজ শোয়ে অনুরোধ আসে বলেই রবীন্দ্রসংগীত গাই। তাই অন্য ইমেজটা মেলে ধরায় আমার কোনও তাগিদ নেই।’’ ঠাকুরপুকুরের ফ্ল্যাটে বসে খোলা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন সোমলতা। পরনে তাঁর লাল কুরুশের টপ ও ডেনিম। তার পর কিছুটা নিস্তব্ধতা। আপনি কি ছোট থেকেই কম কথা বলেন... থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘একেবারেই না। ছোটবেলায় খুবই দুষ্টু ছিলাম। আমার হাতে-পায়ে কত জায়গায় যে কাটা দাগ আছে, তার ইয়ত্তা নেই। মামাবাড়িতে আমার হাসিকে রাবণের হাসি বলা হতো। আমার অট্টহাসিতে বাড়ি গমগম করত। কিন্তু কী যে হল, হঠাৎ করেই পালটে গেলাম। যদিও এর পিছনে কোনও কারণ নেই। এমনিই... ’’
তা হলে সেই খোলা মনের মেয়েটি এখন নিজের সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন? তাঁর এই কম কথা বলার কারণে অনেকে আবার সোমলতাকে আড়ালে অহংকারীও বলেন... কথাটা শুনে বেশ হাসলেন। সোমলতার মতে, তিনি নেহাতই বোরিং একজন মানুষ। তবে সেনসিটিভ আর মুডি বলে তার মধ্যে সিরিয়াস হাবভাবই বেশি। ‘‘কম কথা বলি, হাসি কম বলে অনেকেই এটা আমার অ্যাটিটিউড প্রবলেম বলে মনে করেন। কিন্তু তা নিয়ে কারও সঙ্গে আমার সমস্যা হয়নি।’’ এটাও তো সত্যি যে, মিশুকে না হওয়ার জন্য অনেক কাজ আপনার হাতছাড়া হয়েছে? ‘‘হ্যাঁ, আর একটু সকলের সঙ্গে মিশতে পারলে বছরে ১০টা গানের জায়গায় ২০টা গান হয়তো গাইতে পারতাম। পাঁচটা পুরস্কারও বেশি পেতাম। কিন্তু আমার কোনও ক্ষোভ নেই। আমি অল্পেতেই খুশি।’’
আসলে সোমলতা এমনটাই... কোনও কিছু না পাওয়ার ব্যর্থতা তাঁকে গ্রাস করে না। বরং যা পেয়েছেন সেটাই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে ভালবাসেন। সাইকোলজির শিক্ষিকা হওয়ার জন্যই কি নিজের মনকে এতটা বশে রাখতে পারেন! ‘‘নিজের ও অন্যের মন পড়তে সাইকোলজি পড়তে হয় না,’’ স্বীকারোক্তি তাঁর।
সোমলতা এক্সপেরিমেন্টে বিশ্বাসী। বেগম আখতারের একটি জনপ্রিয় গানকে নতুন করে গাইছেন। তাঁর ব্যান্ড ‘সোমলতা অ্যান্ড দ্য এসেস’-এর সঙ্গে ঠুমরি ও দাদরার উপর ফিউশন করার চিন্তাভাবনা চলছে। তাঁর ব্যান্ড ২০১১-য় যাত্রা শুরু করলেও ২০১৬-য় প্রথম প্রজেক্ট করেছিল। ‘মোর ভাবনারে’ দারুণ সাড়াও ফেলেছিল। কিন্তু ২০১৭-য় প্রথম বার অরিজিনাল সিঙ্গল বের করলেও কোনও কারণে সাফল্য আসেনি। এতেও ভেঙে না পড়ে তিনি মনস্থির করেছেন, আর অ্যালবাম করবেন না। অরিজিনাল কম্পোজিশন নিয়ে সিঙ্গল বানাবেন।
বলিউডে গান গাওয়ার স্বপ্ন দেখেন? ‘‘শ্রেয়া ঘোষাল ‘পিকু’-তে যে ‘জার্নি সং’ গেয়েছেন, তার জন্য অনুপম রায় আমাকে স্ক্র্যাচ করতে বলেছিলেন। মনে হয়েছিল, আমি ঠিক মতো পারব না। কিন্তু তাও পাঠিয়েছিলাম। তার পর অনুপম আরও এক বার আর একটি ছবির জন্য স্ক্র্যাচ গাইয়েছিলেন। কিন্তু কোনওটাই মনোনীত হয়নি। এর পর আর সুযোগ আসেনি। তবে মুম্বইয়ে শিফ্ট করার ইচ্ছে আমার নেই...’’ ভণিতা না করে বললেন।
মিউজিকে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসলেও খুব লাউড মিউজিক কিন্তু সোমলতার পছন্দ নয়। তা বলে তাঁকে বোরিং ভাববেন না যেন। বেশ জোরেই বললেন, ‘‘আমি নিজের মতো থাকি। মুডি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আড্ডা মারতে ভালবাসি না। কাজের বাইরে জয়দা, গাবু, উপলদা, অনিন্দ্যদা, অনুপম... এঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে। এর বাইরেও একটা গ্রুপ আছে, তাদের সঙ্গে বেড়াতে যাই... গান নির্বাচনের মতোই কোন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করব, সে ব্যাপারেও আমি খুব চুজি।’’
অনেকক্ষণ কথাবার্তার পরও ফ্ল্যাটে অন্য কোনও মানুষের অস্তিত্ব টের না পেতে প্রশ্নটা এসেই গেল। ঠাকুরপুকুরের এই ফ্ল্যাটে আপনি কি একা থাকেন? ‘‘আমার হাজব্যান্ড আকাশ (রায়) সদ্য গুরুগ্রামে ফিরে গেল। ও চাকরির কারণে ওখানেই রয়েছে। ও এলে একসঙ্গে ফ্ল্যাটে থাকি।’’ তবে আপনার বিবাহিত জীবন নিয়েও অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। সত্যি কি কোথাও ফাটল... ‘‘পরস্পরের প্রতি আমাদের যথেষ্ট ভরসা আছে। আমরা জানি, কী ভাবে লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ বজায় রাখতে হয়। আমাদের বিয়ের সময়ও গুজব উঠেছিল, আমি নাকি গান-বাজনা ছেড়ে ঘর-সংসার করব। বিয়ের পাঁচ বছর পর গান করেও সম্পর্ক ঠিকঠাক জায়গাতেই রয়েছে। বিয়ের দশ বছর পর প্রমাণ হবে গুজবটা সত্যি কি না!’’ এ বার প্রাণখুলে হাসলেন সোমলতা। আর সেই হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল বারো তলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে আসা বসন্তের হাওয়ার সঙ্গে...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy