Advertisement
১৭ মে ২০২৪

রাহানে রহে

এশিয়া কাপ বিপর্যয়ের মধ্যেও নতুন তারার খোঁজ পেয়েছে ভারত। তারার নাম অজিঙ্কে রাহানে। ঢাকা থেকে কুন্তল চক্রবর্তী।২০০৭ সালের মে মাস। মুম্বইয়ের রঞ্জি ট্রফি দলে তখনও সুযোগ পায়নি এ রকম একটা ছেলের ইন্টারভিউ নেব বলে ঠিক করলাম। ওভাল ময়দান, ক্রস ময়দান, খার জিমখানা যে মাঠেই স্থানীয় ক্রিকেটের খেলা দেখতে যাচ্ছিলাম, সব জায়গাতেই ওঁকে নিয়ে আলোচনা শুনতে পাচ্ছিলাম।

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

২০০৭ সালের মে মাস। মুম্বইয়ের রঞ্জি ট্রফি দলে তখনও সুযোগ পায়নি এ রকম একটা ছেলের ইন্টারভিউ নেব বলে ঠিক করলাম। ওভাল ময়দান, ক্রস ময়দান, খার জিমখানা যে মাঠেই স্থানীয় ক্রিকেটের খেলা দেখতে যাচ্ছিলাম, সব জায়গাতেই ওঁকে নিয়ে আলোচনা শুনতে পাচ্ছিলাম। ব্যাট ধরলেই নাকি বড়-বড় ইনিংস খেলছে। মুম্বইয়ের তখনকার অনূর্ধ্ব ১৬ দলের কোচ মোবিন শেখের কাছ থেকে ছেলেটার ফোন নম্বর নিলাম। রাতে কথা বলে ঠিক হল পরদিন সকাল সওয়া দশটায় বান্দ্রা কুর্লা কমপ্লেক্সের মাঠে দেখা করব। ইন্টারভিউটা যেহেতু টিভিতে দেখানো হবে, তাই অনুরোধ করে রাখলাম যেন কিট ব্যাগটা নিয়েই মাঠে আসে। পরদিন সকালে সওয়া দশটাতে মাঠে পৌঁছে প্রায় মিনিট চল্লিশ অপেক্ষা করার পর ছেলেটা অটোয় চড়ে এল। পরিচয় হতেই বলল, “নো এক্সকিউজ দাদা। স্যরি, অনেকটা লেট হয়ে গেল। কিট ব্যাগটা নিয়ে আসতে হবে বলে দু’টো ট্রেন ছাড়তে হল। খুব ভিড় ছিল।”

এর ঠিক ছ’বছর পর ফিরোজ শাহ্ কোটলায় ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের শেষে অজিঙ্কে রাহানেকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ঝুঁকি নিয়ে স্লগ-স্যুইপ খেলে আউট হওয়ার কোনও দরকার ছিল কি? সেই ম্যাচেই অসফল টেস্ট অভিষেক হয়েছিল অজিঙ্কের। উত্তর এসেছিল, “নো এক্সকিউজ দাদা। ভুলগুলো খুব দ্রুত শোধরাতে হবে।”

বর্তমান ভারতীয় দলে তিনটে ফর্ম্যাটেই জায়গা পাকা করে নিয়েও চরিত্রগত দিক থেকে এতটুকু বদলাননি অজিঙ্কে রাহানে। ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিরূদ্ধে শতরান করার পরেও বলতে শুনেছি, “ডারবানেই কেরিয়ারের প্রথম শতরানটা চলে আসা উচিত ছিল।”

২০০০ সালে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার একটা টেস্ট ম্যাচ চলাকালীন অনেক চেষ্টা করেও রাহুল দ্রাবিড়ের একটা অটোগ্রাফ না পাওয়া অজিঙ্কে রাহানে নিজেকে গড়ে তুলছেন রাহুল দ্রাবিড়ের আদর্শে। তাই হয়তো ভুল করলেই অজুহাত খোঁজার চেষ্টা না করে কী করে নিজেকে ঠিক করতে হবে, সেটার ওপরেই জোর থাকে অজিঙ্কের।

২০০৭-য়ে প্রথম বার কথা হওয়ার কয়েক মাস পরেই মুম্বই দল থেকে ওঁর ডাক চলে এসেছিল। করাচীতে অভিষেকেই শতরান, দলীপ ট্রফিতে ইংল্যান্ড লায়ন্সের বিরুদ্ধে ১৭২ রান থেকে শুরু করে টানা দু’বছর রান করে যাওয়ার পরও ডাক আসছিল না ভারতীয় দলে। ওপেনিংয়ে তখন গম্ভীর-সহবাগ জুটি ফর্মে। সুযোগ আসবে কোথা থেকে? কেউ-কেউ পরামর্শ দিলেন মুম্বইয়ের হয়ে তিন নম্বরে খেললে ভাল হবে। এর পর ব্যাটিং অর্ডারে জায়গা বদলে দু’বছরে ছ’টা শতরান করেও ভারতীয় দলের বাইরেই থাকছিলেন। ঠিক সে সময় আইপিএল চলাকালীন কথা হয়েছিল। বললাম তোমার হার্ড লাক, সুযোগ পাওয়া উচিত ছিল। অজিঙ্কে বলেছিল, “ক্রিকেট মে হার্ড লাক কুছ নহি হোতা হ্যায় রে। শতককে কাম নহি হোগা তো ডাবল হান্ড্রেড মারনা পড়েগা। নহি তো ট্রিপল। সিলেক্টর লোগ কভি না কভি তো ন্যাশনাল সাইড কে লিয়ে জরুর কনসিডার করেগা।”

২০০৭-য়ে ওর ফোন নম্বর নিয়েছিলাম যাঁর কাছ থেকে, সেই মোবিন শেখ বলেছিলেন, “বহুত ঘাড়ুস ক্রিকেটার হ্যায় অজিঙ্কে।” প্রথমটায় দেখে সে রকম কিছু বুঝিনি। মোবিনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোথায় ঘাড়ুস দেখলেন আপনি? এ তো চুপচাপ থাকে। ওর মুখটা দেখে কিছু বিচার করতে বারণ করেছিলেন মুম্বইয়ের অভিজ্ঞ কোচ মোবিন। মুম্বইয়ের আরেক কোচ ও পরিচিত কার্টুনিস্ট অস্টিন কুটিনহোর অবশ্য অজিঙ্কে রাহানেকে নিয়ে আক্ষেপ এখনও মেটেনি। ওয়েলিংটনে ওর প্রথম টেস্ট শতরান দেখার পর বরং আরও বেড়েছে বলা যায়। ভারতের ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের বয়স যখন ১৫, তখন বাবাকে সঙ্গে নিয়ে অস্টিনের কাছে গিয়েছিলেন অজিঙ্কে। অনুরোধ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্টিলাইজার্স (আরসিএফ) দলের হয়ে অফিস লিগে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। অস্টিন তখন আরসিএফ ক্রিকেট দলের দায়িত্বে রয়েছেন। এ দিকে রাহানের মেন্টর মুম্বই রঞ্জি দলের বাঁ-হাতি স্পিনার সঞ্জয় পাতিল চাইছিলেন না ডোম্বিভলির অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন ছেড়ে আরসিএফ-য়ের হয়ে খেলতে যাক অজিঙ্কে। কারণ ছিল আরসিএফ-য়ের মাঠ। যেখানে ছিল সেই চেম্বুরের সঙ্গে অজিঙ্কের অ্যাকাডেমির দূরত্ব। সঞ্জয় তাঁর বন্ধু অস্টিনকে নিজের ইচ্ছের কথা জানানোর পর আরসিএফ-য়ের হয়ে খেলা হয়নি অজিঙ্কের। এখনও তাই আক্ষেপটা রয়ে গিয়েছে মুম্বইয়ের কার্টুনিস্ট কাম ক্রিকেট কোচের। কয়েক দিন আগে চেম্বুরে তাঁর পুরনো ছাত্রদের নিয়ে পুনর্মিলন উৎসব করলেন অস্টিন। সেখানে আইপিএল থেকে নামডাক হওয়া আদিত্য তারেকে অস্টিন বলতে শুনেছেন, “প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কেউ সফল হতে হলে অজিঙ্কে রাহানের থেকে শিখুক। ও যেটাই করতে চায়, সেখানে ১১০ শতাংশ দিয়ে দেয়।”

শুধু ব্যাটিং নয়, ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট অজিঙ্কে রাহানে ভারতীয় দলে নজর কেড়েছেন তাঁর দুরন্ত ফিল্ডিংয়ের জন্যও। সঙ্গে অবশ্যই ক্রিকেট নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা। দিলীপ বেঙ্গসরকর বলছিলেন, “অজিঙ্কে ক্রিকেটের খুব মনোযোগী ছাত্র। যে ভাবে এগোচ্ছে, বহু দূর পৌঁছতেই পারে। সব থেকে ভাল হল, মাঠ বা মাঠের বাইরে ও যে ভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করে, সেই ব্যাপারটা।”

আইপিএল-য়ে টানা সফল রাহানে সাদা পোশাকের ফর্ম্যাট সব থেকে বেশি পছন্দ করলেও তিনটে ফর্ম্যাট নিয়েই প্রচণ্ড সিরিয়াস। পাঁচ দিনের ক্রিকেট থেকে কুড়ি-কুড়িতে নিজেকে বদলে নিতে অসুবিধে হয় না? জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওঁকে। “রাহুল ভাইয়ের কাছ থেকে গত কয়েক বছরে এই ব্যাপারটাই সব থেকে ভাল আয়ত্ত করেছি,” বলছিল ভারতের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান।

মরাঠি ভাষায় অজিঙ্কে শব্দের মানে সর্বজিৎ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রোজ জেতা বা জেতানো কোনওটাই হয়তো সম্ভব নয়, জানা অজিঙ্কের। আর তাই সাফল্য-ব্যর্থতার মাঝে নিজেকে ধরে রাখতে রাহুল দ্রাবিড়ের মডেলই অনুসরণ করছেন মুম্বইয়ের আজ্জু। ফেসবুকে কয়েক মাস আগেও নিয়মিত মেসেজের রিপ্লাই দিতেন। ভারতীয় দলে নিয়মিত হওয়ার পর থেকে বন্ধু থেকে চেনাজানা লোকজনের যোগাযোগ এত বাড়তে থাকে যে সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। কয়েক দিন আগে ফেসবুক অ্যাকাউন্টও তাই ডি-অ্যাক্টিভ করেছেন। বদলে খুলেছে রাহানের অফিশিয়াল পেজ।

বর্তমান ভারতীয় দলের সেরা দুই বাজি বিরাট কোহলি ও চেতেশ্বর পূজারার মিশেল যেন অজিঙ্কে রাহানে। যে প্রয়োজনে আক্রমণ করতে পারে। আর দরকার পড়লে খোলসে গুটিয়েও যাবে। ইদানীং কঠিন ব্যাটিং উইকেটে নজরকাড়া পারফরম্যান্স করে অজিঙ্কে রাহানে কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছে সর্বজিৎ না হলেও আগামী দিনে ভারতকে ও কিন্তু এ রকমই চুপচাপ থেকে বহু ম্যাচ জেতাতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ajinkya rahane kuntal chakraborty indian cricketer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE