Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আসছে না টাকা, শিকেয় উঠবে কি রোগী কল্যাণ

পেয়িং বেড বলে কিছু নেই। এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা রক্তপরীক্ষার জন্যও টাকা লাগে না। গরিব রোগীদের কথা ভেবে রাজ্যের জেলা, মহকুমা, স্টেট জেনারেল ও গ্রামীণ হাসপাতালে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে। ওই সব খাতে আদায় হওয়া টাকা জমা পড়ত রোগী কল্যাণ সমিতির তহবিলে। হাসপাতালগুলির উদ্বিগ্ন কর্তারা বলছেন, টাকা আসছে না রোগী কল্যাণে। সেই কাজ তাই শিকেয় ওঠার জোগাড়। স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য বলছেন, উপায় আছে। হাসপাতালগুলিকেই তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪৩
Share: Save:

পেয়িং বেড বলে কিছু নেই। এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা রক্তপরীক্ষার জন্যও টাকা লাগে না। গরিব রোগীদের কথা ভেবে রাজ্যের জেলা, মহকুমা, স্টেট জেনারেল ও গ্রামীণ হাসপাতালে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে। ওই সব খাতে আদায় হওয়া টাকা জমা পড়ত রোগী কল্যাণ সমিতির তহবিলে। হাসপাতালগুলির উদ্বিগ্ন কর্তারা বলছেন, টাকা আসছে না রোগী কল্যাণে। সেই কাজ তাই শিকেয় ওঠার জোগাড়। স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য বলছেন, উপায় আছে। হাসপাতালগুলিকেই তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। আরও বেশি রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার কার্ডধারী গরিব রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে উদ্যোগী হতে হবে তাদের। কিন্তু তাতেই সমস্যা মিটবে এমনটা-ও মনে করছেন না হাসপাতালগুলির কর্তারা।

কারণ, হাসপাতালে যতটা জরুরি ভিত্তিতে মেরামতির কাজ করা প্রয়োজন, পূর্ত দফতরের পক্ষে তা সম্ভব হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। তাই রোগীকল্যাণ সমিতি (আরকেএস)-এ জমা পড়া টাকাই জরুরি কাজে ব্যবহার করা হয়। পরে দেয় ট্রেজারি। হাসপাতালগুলিতে গড়ে ১৫০-২০০টি করে পেয়িং বেড ছিল। বেড-পিছু দিনে ৩০-৫০ টাকা ভাড়া, কেবিন-পিছু দিনে ৪০০-৫০০ টাকা ও বিভিন্ন পরীক্ষা মিলিয়ে মাসে প্রায় ৪-৬ লাখ টাকা জমা পড়ত এক-একটি জেলা বা মহকুমা হাসপাতালের আরকেএসে। নানা সময় সেই টাকার কিছু অংশ্য নয়ছয় হওয়ার অভিযোগ উঠলেও পরিষেবা চালু রাখার ক্ষেত্রে ওই তহবিল বিশেষ কাজে লাগত।

মুর্শিদাবাদের এক মহকুমা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর দু’মাস হতে চলল। আমাদের আরকেএসে টাকা আসছে না। রাতবিরেতে জলের ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে গিয়েছে, বিদ্যুতের ফিউজ লাগাতে হবে, হাসপাতাল চত্বরের ময়লা সাফ করতে হবে, কুকুর-বেড়াল-আরশোলা তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আরকেএসের টাকা বাড়ন্ত। কিচ্ছু করা যাচ্ছে না।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক স্টেট জেনারেল হাসপাতালের সুপার বলেন, “অক্টোবরের শেষ থেকেই সমস্যাটা ভাল রকম টের পেতে শুরু করেছি। হঠাৎ এসি মেশিন চুরি হয়ে গেল, জেনারেটর খারাপ, সিসিটিভি বা ইন্টারকম বসাতে হবে, মর্গে মৃতদেহ সংরক্ষণে বরফ আনতে হবে। এত দিন আরকেএস থেকেই এই খরচ করেছি। এখন তা হবে কী করে?”

বাঁকুড়া জেলা হাসপাতালের এক কর্তার কথায়, “জরুরি ওষুধের লরি আসতে দেরি হচ্ছে, এমন সময় আরকেএসের টাকায় ওষুধপত্র কিনে রোগীদের দেওয়া হয়েছে। এ সব এখন করা যাচ্ছে না।” উত্তর ২৪ পরগনার এক স্টেট জেনারেল হাসপাতালের সুপারের আক্ষেপ, “পরিবারহীন-সহায়হীন রোগীদের ওষুধ-পথ্য থেকে সাবান-শ্যাম্পু, জামাকাপড় সব কিছুর ব্যবস্থা করা হত আরকেএস থেকে। এখন এই রোগীদের ভর্তি নেওয়ার আগে দু’বার ভাবতে হবে।”

মালদহের এক মহকুমা হাসপাতালের সুপার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, নিয়ম হল রোগীদের প্রয়োজনে আগে খরচ করতে হবে। পরে ট্রেজারি তা ফেরত দেবে। কিন্তু গোড়ায় চটজলদি ওই খরচ করবে কে? সুপার কি নিজের পকেট থেকে টাকা দেবেন? এত দিন তাই ট্রেজারির বদলে রোগীকল্যাণ সমিতির টাকা থেকে খরচগুলো হতো। টাকার উৎস শুকিয়ে গেলে রোগীকল্যাণমূলক কাজ ধাক্কা খাবে।

স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষস্থানীয় কর্তারা অবশ্য একে সমস্যা বলে মানতে রাজি নন। তাঁরা বিকল্প পথ হিসেবে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা’ (আরএসবিওয়াই)-এর কথা বলছেন। স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে দাবি করছেন, জেলা ও ব্লক স্তরের সব হাসপাতালের আরকেএস মিলিয়ে মাসে ১০ কোটি টাকার মতো আয় হতো। আরএসবিওয়াই প্রকল্প ভাল ভাবে চালানো গেলে রোগী কল্যাণ তহবিলে মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকা আসবে। মলয়বাবুর কথায়, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হলে তবেই তাঁরা আরএসবিওয়াই-এর রোগী পাবেন। তাঁরা সেই পরিশ্রম করতে চাইছেন না বলে আরকেএসের টাকা নিয়ে সমস্যার গল্প শোনাচ্ছেন।”

জেলা প্রশাসন বিভিন্ন শিবিরের আয়োজন করে বিপিএল তালিকাভুক্তদের হাতে ওই রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমার কার্ড দিয়ে থাকে। যা দিয়ে বছরে মাত্র ৩০ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে ৫ সদস্যের কোনও পরিবার ৩০ হাজার টাকার চিকিৎসা পেতে পারে। গত ৯ মাসে রাজ্যের মোট ১২৭টি সরকারি হাসপাতাল মিলে আরএসবিওয়াই-এর মাধ্যমে আয় করেছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ হিসেব করলে এক-একটি হাসপাতালের আরকেএস তহবিলে মাসে এক-দেড় লাখ টাকার বেশি থাকার কথা নয়। স্বাস্থ্য দফতরেই প্রশ্ন উঠেছে, যে সব হাসপাতালকে গত আড়াই বছরে তৎপর করে তোলা গেল না, তারা কোন জাদুতে আদাজল খেয়ে আরএসবিওয়াই কার্ডধারী রোগী খুঁজতে শুরু করবে? বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করালেও যেখানে বিমার টাকা মেলে। চিকিৎসকরাও অনেকে আর্থিক স্বার্থে বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রোগীদের উৎসাহ জোগান। রোগীরাও অনেকে ভাল চিকিৎসা, সাফসুতরো পরিবেশের আশায় বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে পছন্দ করেন।

স্বাস্থ্যসচিবের অবশ্য বক্তব্য, “গত ন’-দশ মাসে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। সিতাইয়ের ছোট গ্রামীণ হাসপাতাল ৬ মাসে আরএসবিওয়াই থেকে আরকেএসে ১৭ লক্ষ টাকা আয় করেছে। হলদিবাড়ি গ্রামীণ হাসপাতাল ৬ মাসে ৫ লক্ষ টাকা, বালুরঘাট হাসপাতাল ১৩ লক্ষ, সবং হাসপাতাল ৪ মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করেছে।” মলয়বাবুর প্রশ্ন, “ওরা পারলে বাকিরা পারবে না কেন?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay rogi kalyan samity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE