Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ক্যানসার জয় করে নাচে ফিরতে দৃঢ় কিশোরী

তার আঁকা দুর্গা ঠাকুরের ছবি দিয়ে তৈরি হওয়া কার্ড বিক্রি হবে বাজারে। আর সেই টাকায় নতুন জীবন পাবে সে। এমনই আশা নিয়ে বসে আছে অঞ্জলি। ১২ বছরের অঞ্জলি রায়। শিশু নৃত্যশিল্পী হিসেবে খ্যাতি যখন একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনই বাঁ পায়ে ক্যানসার ধরা পড়ে তার। চিকিত্‌সার অঙ্গ হিসেবেই ওই পা বাদ দিতে বাধ্য হন চিকিত্‌সকেরা। হতদরিদ্র পরিবারের ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে তাকে চিকিত্‌সায় সাহায্য করেছেন বহু চিকিত্‌সক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ বার তার আঁকা কার্ড বাজারে বিক্রি করে অঞ্জলির নকল পায়ের ব্যবস্থা করতে চলেছেন তাঁরা। এ বারের পুজো তাই তার কাছে নতুন জীবন পাওয়ার পুজো।

অঞ্জলি রায়।—নিজস্ব চিত্র।

অঞ্জলি রায়।—নিজস্ব চিত্র।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৫২
Share: Save:

তার আঁকা দুর্গা ঠাকুরের ছবি দিয়ে তৈরি হওয়া কার্ড বিক্রি হবে বাজারে। আর সেই টাকায় নতুন জীবন পাবে সে। এমনই আশা নিয়ে বসে আছে অঞ্জলি। ১২ বছরের অঞ্জলি রায়।

শিশু নৃত্যশিল্পী হিসেবে খ্যাতি যখন একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনই বাঁ পায়ে ক্যানসার ধরা পড়ে তার। চিকিত্‌সার অঙ্গ হিসেবেই ওই পা বাদ দিতে বাধ্য হন চিকিত্‌সকেরা। হতদরিদ্র পরিবারের ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে তাকে চিকিত্‌সায় সাহায্য করেছেন বহু চিকিত্‌সক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ বার তার আঁকা কার্ড বাজারে বিক্রি করে অঞ্জলির নকল পায়ের ব্যবস্থা করতে চলেছেন তাঁরা। এ বারের পুজো তাই তার কাছে নতুন জীবন পাওয়ার পুজো।

হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে অঞ্জলি একেবারে ছোট্টবেলা থেকেই খুব ভাল ভরতনাট্যম নাচত। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বহু পুরস্কারও পেয়েছে। একাধিক রিয়্যালিটি শো-তেও তার নাচ অনেকের নজর কেড়েছিল। তার পরে একদিন পায়ে ক্যানসার ধরা পড়ল তার। চিকিত্‌সা পরিভাষায় যে ক্যানসারের নাম অস্টিওসার্কোমা। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় ঠাকুরপুকুরের একটি ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি করা হল অঞ্জলিকে। দীর্ঘ চিকিত্‌সায় মারণ রোগের হাত থেকে বাঁচল ঠিকই, কিন্তু বাদ গেল একটি পা। মেয়েটার নাচ বন্ধ হয়ে যাবে ভেবে চোখের জল ফেলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু অঞ্জলি দমেনি।

কেন? তার কথায়, “ডাক্তাররা আমাকে সুধা চন্দ্রনের গল্প শুনিয়েছিলেন। যাঁর কাছে নাচ শিখতাম, তিনি আমাকে ‘নাচে ময়ূরী’ সিনেমাটার সিডি দিয়েছিলেন। মন দিয়ে দেখলাম সিনেমাটা। সুধা চন্দ্রনেরও তো আসল পা ছিল না। নকল পা নিয়েও কী অসম্ভব ভাল নাচতে পারেন তিনি। আমার মা বলেছেন, চেষ্টা করলে সব পারা যায়। আমিও পারব।”

কিন্তু পারতে গেলে মনের জোরের পাশাপাশি আর একটা জিনিসেরও প্রয়োজন হয়। সেটা হল একটা উন্নত মানের নকল পা। আপাতত সেটাই জোগাড় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সেই মেয়ে। শুধু অন্যের সাহায্যের ভরসায় না থেকে নিজেও টাকা উপার্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। অঞ্জলির কথায়, “নাচ ছাড়া আর একটা জিনিসই আমি ভাল পারি। সেটা হল ছবি আঁকা। ছবি এঁকে কার্ড বানাচ্ছি। সেই কার্ড বিক্রি করে কিছুটা টাকা জোগাড় করতে পারব আশা করি।”

ঠাকুরপুকুরের ওই হাসপাতালের আর্ট থেরাপিস্ট পাপড়ি সাহা বলেন, “অঞ্জলির যখন নাচ বন্ধ হয়ে গেল, তখন আমাদের মনে হয়েছিল অন্য কোনও একটা সৃজনশীল কাজের মধ্যে ওকে যুক্ত না করলে ওর পক্ষে এই লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সেই জন্য আমরাও ওকে সব সময়ে ছবি আঁকার ব্যাপারে উত্‌সাহ দিয়ে গেছি।”

অঞ্জলির চিকিত্‌সক সোমা দে ঠাকুর বলেন, “ওর মনের জোর অসাধারণ। পা বাদ দিতে হবে, এটা যখন আমরা বুঝতে পারলাম, তখন আমাদের পক্ষেই সেটা মেনে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। কারণ ওর নাচের বিষয়টা আমরা জানতাম। অঞ্জলি বয়সে অত ছোট হয়েও কিন্তু ভেঙে পড়েনি। ওর একটাই কথা, যে ভাবে হোক ভাল হতে হবে। তার পর নাচে ফেরা কেউ আটকাতে পারবে না।”

কাকে বলে অস্টিওসার্কোমা? চিকিত্‌সকেরা জানিয়েছেন, হাড়ের এক ধরনের টিউমারকে অস্টিওসার্কোমা বলা হয়। সাধারণত শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। সাধারণ ভাবে হাড়ে ব্যথাই এই রোগের প্রধান উপসর্গ। কুঁচকির কাছে বা হাঁটুর নীচে এই ধরনের টিউমার বেশি হয়। এর ফলে হাড় খুবই

ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, অল্প আঘাতেই হাড় ভাঙার ভয় থাকে। এর কারণ এখনও পর্যন্ত সঠিক ভাবে জানা যায়নি। তবে একটি বিশেষ জিনকে এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হয়। ওই জিনটি থেকে শিশুদের চোখের ক্যানসারও হয়।

সুভাষগ্রামের এক চিলতে ঘরে অঞ্জলির মা রীতা রায় বলেন, “আমার মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ত। তখনই ওর ক্যানসার ধরা পড়ে। এক বছরেরও বেশি স্কুল যাওয়া বন্ধ। এ বার আবার ওকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। মেয়ে নিজেই বলছে, ‘‘লেখাপড়া না শিখলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব কী করে?”

অঞ্জলির বাবা একটি গেঞ্জি কারখানায় অত্যন্ত কম বেতনের চাকরি করেন। স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সংসার চালাতেই যাঁর নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়, তিনি এত বড় একটা ব্যয়বহুল চিকিত্‌সার ভার নেবেন কী ভাবে?

যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই কাজে অঞ্জলির পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের তরফে পার্থ সরকার বলেন, “যুবরাজ সিংহের ফিরে আসার কথা সকলে জানেন, আমরা চাই অঞ্জলির লড়াইয়ের কথাও মানুষ জানুন। ওকে দেখে অনেকেই এই মারণ রোগের সঙ্গে লড়াই করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার মানসিক শক্তি পাবেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cancer anjali roy soma mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE