Advertisement
১০ মে ২০২৪
সঙ্কটে ফ্রি চিকিৎসা

দাতব্যের কড়ি জোগাবে কে, স্বাস্থ্যভবন আঁধারে

প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ। কিন্তু বাস্তব যে সব সময় প্রতিশ্রুতি রেখে চলে না, ওঁর বিপন্ন মুখই তা বলে দিচ্ছে। এসএসকেএমে বার্ন ইউনিটের বাইরে দাঁড়ানো যুবকটির হাতে ২৬ হাজার টাকার ওষুধের বিল! জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ভর্তি নিকটাত্মীয়ার জন্য এলগিন রোডের দোকান থেকে ওষুধগুলো কিনে এনেছেন।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০২:২২
Share: Save:

প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ। কিন্তু বাস্তব যে সব সময় প্রতিশ্রুতি রেখে চলে না, ওঁর বিপন্ন মুখই তা বলে দিচ্ছে। এসএসকেএমে বার্ন ইউনিটের বাইরে দাঁড়ানো যুবকটির হাতে ২৬ হাজার টাকার ওষুধের বিল!

জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ভর্তি নিকটাত্মীয়ার জন্য এলগিন রোডের দোকান থেকে ওষুধগুলো কিনে এনেছেন। এই নিয়ে গত তিন সপ্তাহে মোট ৫১ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে। ওষুধ তো হাসপাতাল থেকেই পাওয়ার কথা!

অসহায় কণ্ঠে যুবক জানালেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, দামি অ্যান্টিবায়োটিক না-দিলে বিপদ হতে পারে। এ দিকে হাসপাতালে তার সাপ্লাই নেই।’’

অগত্যা বাইরের দোকানই ভরসা। এত খরচ ক’দিন জুগিয়ে উঠতে পারবেন, তা ভেবে বহু রোগীর পরিজন দুশ্চিন্তায় আকুল। যেমন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সার্জারিতে ভর্তি এক তরুণের পরিবার। ছেলেটির হাতের একটা অস্ত্রোপচার বাবদ নয় নয় করে তিরিশ হাজার টাকা পকেট থেকে বেরিয়েছে। ‘‘অপারেশনের ঠিক আগে ওষুধের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলা হল, তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন। আমরা না-এনে দিলে হয়তো অপারেশনই হতো না!’’— আক্ষেপ
রোগীর এক আত্মীয়ের।

আবার এনআরএসের অর্থোপেডিকে এক বৃদ্ধের পায় ধাতব পাত বসাতে বাড়ির লোককে ১৮ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। প্লেটটাও কিনে দিতে হয়েছে। ডাক্তারবাবু নিজেই সাদা কাগজে লিখে দিয়েছিলেন, কোথায় পাওয়া যাবে। হাসপাতাল সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, এ সব জিনিস হাসপাতালে সাপ্লাই হয় না। সাপ্লাই না-হওয়া সব কিছুই বাইরে থেকে কিনতে হবে।

রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে এমন অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে, যা কিনা এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য দফতরের গলায় বড় কাঁটা। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষিত ‘ফ্রি চিকিৎসা’ কি তা হলে আষাঢ়ে গল্প হয়ে দাঁড়াল?

স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্নটা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। প্রমাদ গুনছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। ভোটের মুখে এমন হলে তাঁদের উপরে খাঁড়ার ঘা নেমে আসতে পারে ভেবে ওঁরা তটস্থ। মেডিক্যাল কলেজগুলোর সহকারী সুপারদের স্বাস্থ্যভবনে ডেকে হুঁশিয়ারি দিতে কসুর করেননি। হাসপাতাল-কর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যত দামি ওষুধই লাগুক, হাসপাতালকেই কিনে দিতে হবে।

শুধু মুখে বলা নয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ঘুরে ডাক্তারদের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক শুরু করেছেন। যেমন বুধবার কলকাতা মেডিক্যালে গিয়ে তিনি নির্দেশ
দিয়ে এসেছেন, দামি অ্যান্টিবায়োটিক হোক বা সরঞ্জাম— কিছুই যেন রোগীকে কিনতে না হয়। সুশান্তবাবুর কথায়, ‘‘আমরা সব হাসপাতালকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, প্রেসক্রিপশনের যাবতীয় জিনিস নিখরচায় দিতে
হবে। দেখা হচ্ছে, সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স মারফত কী ভাবে সব কিছু কেনা যায়।’’

আর তা না-হওয়া পর্যন্ত ‘লোকাল পারচেজ’ করা হবে বলে জানিয়েছেন অধিকর্তা। ‘‘হাসপাতালই ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে কিনে রোগীকে দেবে।’’— বলছেন তিনি। শুনে সুপারদের প্রশ্ন— এর জন্য যে বিপুল টাকা দরকার, সেটা আসবে কোথা থেকে? যার জবাবে সুশান্তবাবুর প্রত্যয়ী ঘোষণা, ‘‘সরকারের টাকার কোনও সমস্যা নেই। প্রয়োজনে আমরা দশ গুণ বরাদ্দ বাড়াব।’’

অধিকর্তার এ হেন আশ্বাসবাণীতেও কিন্তু হাসপাতালের কর্তারা আশ্বস্ত হতে পারছেন না।

কেন?

ওঁদের সিংহভাগের বক্তব্য: সব বেড ‘ফ্রি’ করার নামে সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। হয়তো বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত এ ভাবে সামলানো যাবে। ‘‘তার পরে কী হবে? এমনিতেই তো টানাটানির সংসার!’’— বলছেন সুপারদের অনেকে। ওঁদের আশঙ্কা, ভোটের পরেও ‘খয়রাতি’ বহাল থাকলে পরিণাম মারাত্মক হবে। কারণ, তখন বহু ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা যাবে না। আর তার পুরো দায়টাই বর্তাবে হাসপাতালের ঘাড়ে। এমতাবস্থায় জনরোষ ফেটে পড়লে কী হবে, স্বাস্থ্যভবনের তরফে তার কোনও ব্যাখ্যা সুপারেরা পাননি।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪-র অক্টোবর থেকে রাজ্যের গ্রামীণ ও জেলা হাসপাতালে পেয়িং বেড, আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অস্ত্রোপচারের খরচ মকুব হয়ে গিয়েছে। উপরন্তু গত সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন, মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও এপিএল-বিপিএল নির্বিশেষে চিকিৎসা মিলবে নিখরচায়। বাড়তি টাকার সংস্থান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা হাসপাতাল-কর্তাদের মহা ফাঁপরে ফেলে দিয়েছে। বস্তুতই ওঁরা কূল-কিনারা পাচ্ছেন না।

পরিণামে ঘোষণা অনেক ক্ষেত্রে রয়ে যাচ্ছে নেহাত মুখের কথা হয়ে। বহু জায়গায় ‘ফ্রি’ বলতে শুধু শয্যা, মামুলি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও কিছু ওষুধ। বাকি সব খরচের ভার রোগীর উপরেই বর্তাচ্ছে। ‘‘খবরটা মুখ্যমন্ত্রীর কানেও পৌঁছেছে। আমরা তিরস্কৃত হয়েছি। তবে বুঝতে পারছি না, সব ফ্রি করার মতো অত বাড়তি টাকা কোত্থেকে আসবে।’’— কবুল করছেন এক শীর্ষ স্বাস্থ্য-কর্তা। তিনি বলেন, ‘‘আপাতত ঠিক হয়েছে, যেখান থেকে যত টাকা মিলবে, সবটাই ওষুধ কিনতে লাগানো হবে। ডাক্তারদের বলেছি, যতটা সম্ভব হাসপাতালের ফার্মাসি-লিস্ট দেখে ওষুধ প্রেসক্রাইব করুন। একান্ত সম্ভব না-হলে অন্য ওষুধ লিখুন।’’ যদিও লোকাল পারচেজে’ সেই ওষুধ রোগীকে কিনে দেওয়ার টাকা নিয়মিত কে জোগাবে, তার হদিস
স্বাস্থ্যভবনের কাছে নেই।

সব মিলিয়ে ‘ফ্রি চিকিৎসা’ এখন ঘুরপাক খাচ্ছে জটিল বিভ্রান্তির মহা-আবর্তে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE