পুজোর পরেই ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ (এমসিআই)-র প্রতিনিধিরা আবার পরিদর্শনে আসছেন। এ দিকে, পরিকাঠামোর উন্নয়ন দূরে থাক, কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এখনও বিকেল চারটের পরে ইমার্জেন্সি অস্ত্রোপচারই চালু করা যায়নি। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত রোগী হোক বা আসন্ন প্রসূতির সিজার, চারটের পর থেকে সাগর দত্ত হাসপাতালে এলেই ‘রেফার’ হতে হবে।
কোনও মেডিক্যাল কলেজ স্তরের হাসপাতালে এ জিনিস চলতে পারে না বলে কয়েক মাস আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছিল এমসিআই। এ বছর তারা ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে এতটাই কড়া যে, বিপদ আঁচ করে দিন কয়েক আগেই সাগর দত্তের শীর্ষ কর্তারা রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার দফতরে গিয়েছিলেন। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, সেখানেই তাঁরা জানতে চান, “২৪ ঘণ্টা জরুরি অস্ত্রোপচার চালু না করলে আর এমসিআই-এর অনুমোদন মিলবে না। পুজোর পরেই এমসিআই এলে কী হবে?”
‘কী হবে’ তার উত্তর দিতে পারেননি স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। প্রশ্ন করলে শুধু বলেছেন, “জানি, কঠিন সমস্যা। দেখছি কী করা যায়।” সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের কর্তারা অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত হননি। সেখানকার অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্যের কথায়, “দেখছি-দেখছি তো তিন বছর ধরে শুনছি। কিন্তু কবে থেকে বিকেল চারটের পরেও আমরা অস্ত্রোপচার করতে পারব, জানি না। এ দিকে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। এমসিআই-কে কী দেখাব? ছাত্রছাত্রীরাও ইমার্জেন্সি অস্ত্রোপচার ভাল ভাবে শিখতে পারছেন না। এই ভাবে কি অনুমোদন পাওয়া যায়?”
কিন্তু একটি মেডিক্যাল কলেজে কেন বিকেল চারটের পরে কোনও অস্ত্রোপচার হবে না? অধ্যক্ষের জবাব, “কী করে হবে? ডাক্তার হয়তো চেষ্টা করে পাওয়া গেল, কিন্তু তিনি একা নিশ্চয়ই রোগীকে অ্যানাস্থেশিয়া দেবেন না, যন্ত্রপাতি অটোক্লেভ করবেন না বা রোগীকে ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাবেন না। সে সব করার লোক কোথায়?” তিন বছরেও কেন লোক জোগাড় হল না? সাগর দত্তের কর্তারা বলছেন, “সেটা স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা বলতে পারবেন। আমরা চিঠি লিখে লিখে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। এখন তড়িঘড়ি হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড থেকে লোক নেওয়া হলেও তাঁরা তো রাতারাতি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা দক্ষ হয়ে যাবেন না।” সুশান্তবাবুর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তাঁর উত্তর সেই এক, “বললাম তো, দেখছি।”
একটি মেডিক্যাল কলেজ হওয়া সত্ত্বেও সাগর দত্তে বিকেল চারটের পর থেকে কার্যত সমস্ত জরুরি পরিষেবা বন্ধ হওয়ায় উত্তর ২৪ পরগনার মানুষের আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না। ফলে আর জি করের উপরে মারাত্মক চাপ বাড়ছে, পরিষেবার মান কমছে। সাগর দত্তের আশপাশের একাধিক সরকারি হাসপাতালের কর্তারা অভিযোগ করেছেন, মহকুমা বা স্টেট জেনারেল স্তরের হাসপাতালে অনেক পরিষেবা দেওয়া যায় না। কোনও প্রসূতির জরুরি সিজার দরকার হলে বা দুর্ঘটনার আহতের অস্ত্রোপচার দরকার হলে বিকেলের পরে সাগর দত্ত ফিরিয়ে দিচ্ছে। আর জি করে পৌঁছতে-পৌঁছতে অনেকে রাস্তায় মারা যান। সাগর দত্তের অধ্যক্ষ দেবাশিসবাবু অভিযোগ মেনে বলেছেন, “বিকেল চারটের পরে মস্তিষ্কে আঘাত, হার্ট অ্যাটাক, অ্যাপেনডিক্স ফেটে যাওয়া, দুর্ঘটনায় হাত-পা বাদ যাওয়া, স্ট্রোকের মতো জরুরি কেস এলেও আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আর জি করে রেফার ছাড়া কিচ্ছু করতে পারি না। পরদিন সকাল ন’টা-সাড়ে ন’টা পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকে।”
চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীর অভাব কতটা, যার জন্য সাগর দত্তের পরিষেবার এই হাল?
স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী অ্যানাস্থেটিস্ট দরকার ১৫ জন, রয়েছেন পাঁচ জন। ওটি অ্যাসিন্ট্যান্ট দরকার ২০০ জন, রয়েছেন ৩৩ জন। তার ভিতরে মাত্র এক জন প্রশিক্ষিত। নার্স দরকার ২৫০, রয়েছেন ৪৫ জন। সার্জন দরকার অন্তত ১৫ জন, রয়েছেন ৮ জন। শিশু চিকিৎসক দরকার অন্তত ১০ জন, রয়েছেন ৩ জন। অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে মাত্র একটি। সাগর দত্তের চিকিৎসকেরাই শিয়রে এমসিআই-এর ছায়া দেখে শঙ্কিত হয়ে জানাচ্ছেন, পুজোর পর-পরই যদি স্বাস্থ্য দফতর লোকজনের ব্যবস্থা করে বিকেল চারটের পর থেকে জরুরি পরিষেবা চালু করে তা হলে এ যাত্রায় রক্ষা মিলবে, নচেৎ এই পরিষেবা থাকলে অনুমোদন বাতিল নিশ্চিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy