Advertisement
১১ মে ২০২৪

বড় হাসপাতালে ঢুকে বিলের ঘায়েই ঘায়েল

গাড়ি দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পেয়ে সল্টলেকের এক নামী হাসপাতালে ভর্তি হন সিঁথির পারমিতা ভট্টাচার্য। বাইশটা স্টিচ পড়লেও বড় কোনও শারীরিক সমস্যা হয়নি। বরং দু’দিন ভর্তি থাকার পরে বিল দেখে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। ৫৭ হাজার টাকা!

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০২:২৩
Share: Save:

গাড়ি দুর্ঘটনায় মাথায় চোট পেয়ে সল্টলেকের এক নামী হাসপাতালে ভর্তি হন সিঁথির পারমিতা ভট্টাচার্য। বাইশটা স্টিচ পড়লেও বড় কোনও শারীরিক সমস্যা হয়নি। বরং দু’দিন ভর্তি থাকার পরে বিল দেখে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। ৫৭ হাজার টাকা!

কিডনির রোগ নিয়ে বাইপাসের এক বড় হাসপাতালে ভর্তি হতে গিয়ে সিউড়ির অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাঁর সমস্যা শুনে হাসপাতাল প্রথমে জানায়, ২৬ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। কিন্তু অপূর্ববাবু রাজ্য হেল্থ স্কিমের অন্তর্ভুক্ত শুনেই অঙ্কটা নেমে আসে ১৪ হাজারে। যদি চোদ্দোতেই ওই চিকিৎসা দেওয়া যায়, তা হলে ছাব্বিশ হাঁকা হল কেন?

অপূর্ববাবু যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাননি। যেমন পাননি দমদম পার্কের সঞ্জীব চক্রবর্তী। নাগেরবাজারের এক হাসপাতালে তিনি আর এক রোগীর সঙ্গে ঘর ভাগ করে দু’দিন ছিলেন। পরে কেবিনে চলে যান। ডিসচার্জের সময়ে বিল দেখে ওঁরা হাঁ! ভাগের ঘরে থাকাকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে চার্জ, কেবিনে সেটা দ্বিগুণ!

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তর্ক করে সুরাহা মেলেনি। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ছাড়া অন্য হাসপাতালে ভর্তি হলে বহু মানুষের এমন নানা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, যুক্তি-বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যামেলে না। অনেক ক্ষেত্রেই খরচের মাথা-মুণ্ডু থাকে না বলে অভিযোগ। বিভিন্ন রাজ্যে এমন সব হাসপাতালের চিকিৎসা-খরচ সম্পর্কে ২০১৪-র জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ণ মন্ত্রক একটা সমীক্ষা চালিয়েছিল। তার রিপোর্ট বলছে, নামী-দামি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করাতে গেলে সবচেয়ে বেশি টান ধরে দিল্লিবাসীর পকেটে। তালিকায় এর পরেই পশ্চিমবঙ্গ।

এবং বাড়তি ব্যয়ের বিনিময়ে পশ্চিমবঙ্গের রোগীরা যে উন্নততর পরিষেবা পাচ্ছেন, তা-ও নয়। বরং সমীক্ষা-রিপোর্টের দাবি: সমান বা আরও ভাল মানের পরিষেবার জন্য বিজেপিশাসিত মহারাষ্ট্র, বামশাসিত কেরল বা জয়ললিতার তামিলনাড়ুতে রোগীদের টাকা দিতে হয় কম। ঘটনাচক্রে খরচটা সবচেয়ে কম নরেন্দ্র মোদীর গুজরাতে!

কেন এমন হয়?

পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দফতরের তরফে হাসপাতাল সংক্রান্ত একাধিক সমীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অরিজিতা দত্ত বলেন, ‘‘অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, দাম হল গুণমানের নির্ণায়ক। মান ভাল হলে দাম বেশি হবে।’’ কিন্তু রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নিয়মটা সর্বদা খাটছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ যথেষ্ট। বিশেষত সঞ্জীববাবুর অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে অরিজিতার প্রশ্ন, ‘‘ঘর শেয়ার করে থাকলে কি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যত্ন থাকে না? থাকলে কেবিনে বেশি টাকা লাগছে কেন?’’

এমতাবস্থায় স্বচ্ছতা সম্পর্কে ধোঁয়াশা ঘনাচ্ছে। ‘‘অত্যাবশ্যক ওষুধের দাম যদি সরকার বাঁধতে পারে, তা হলে এই সব হাসপাতালে বিভিন্ন খরচের ঊর্ধ্বসীমা কেন বাঁধা হবে না?’’— প্রশ্ন অরিজিতার। যা শুনে রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর জবাব, ‘‘এমন কোনও উপায় আমাদের হাতে নেই। আইনও নেই।’’

কিন্তু অন্যান্য রাজ্যে খরচ কেন কম?

বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, পূর্বাঞ্চলের হাসপাতালগুলির সংগঠনের অন্যতম কর্তা তথা আমরি হাসপাতালের সিইও রূপক বড়ুয়ার দাবি, ‘‘যে তল্লাটের মানুষের আর্থিক সংস্থান বেশি, সেখানকার হাসপাতাল এমনিতেই চার্জ বাড়িয়ে রাখে। তাই দিল্লি-মুম্বই-কলকাতায় খরচ বেশি। চেন্নাই-হায়দরাবাদ-বেঙ্গালুরুতে তুলনায় কম।’’ চিকিৎসক কুণাল সরকারের পর্যবেক্ষণ: গুজরাত, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে নানা সরকারি স্বাস্থ্যবিমা, চিকিৎসা-ফান্ড ইত্যাদির আওতায় বহু মানুষ রয়েছেন। যার সুবাদে তাঁরা নামী-দামি হাসপাতালেও তুলনায় সস্তায় চিকিৎসা পান। পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ওড়িশার মতো রাজ্য এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে বলেই এমন অবস্থা।

রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্য-কর্তা তথা বর্তমানে এক হাসপাতালের শীর্ষ কর্তা অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায় আঙুল তুলেছেন চিকিৎসকদের একাংশের দিকে। ‘‘পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ বড় হাসপাতালে (বেসরকারি) ডাক্তারেরা স্থায়ী চাকরি করেন না। তাঁরা পার্ট টাইমার। তাই ওঁদের ফি-র উপরে হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অথচ বিলের ৪৫% হল ডাক্তারের ফি।’’— বলছেন তিনি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যে ডাক্তারেরা হাসপাতালের মাইনে করা কর্মী। মর্জিমাফিক ফি নিতে পারেন না।’’

দুর্গাপুরের এক হাসপাতালের অধিকর্তা সত্যজিৎ বসু জানিয়েছেন, অনেক অস্ত্রোপচার দক্ষিণের তুলনায় এখন এ রাজ্যে কম খরচে হচ্ছে। তবে অন্ধ্র, তামিলনাড়ুর মতো কিছু রাজ্যে সরকার থেকে এপিএল-বিপিএল তালিকাভুক্তদের জন্য আলাদা আলাদা চিকিৎসা-প্যাকেজ ঠিক করা আছে। ‘‘ফলে নামী হাসপাতালে ভর্তি হলেও খরচ একটা মাত্রার মধ্যে থাকে।’’— মন্তব্য সত্যজিৎবাবুর।

পূর্বাঞ্চলের এমন সব হাসপাতাল সংগঠনের প্রধান রূপালি বসু মনে করছেন, সরকারি বিধির আগল যখন নেই, তখন বাড়তি আয়ের তাগিদ থাকবেই। তাঁর কথায়, ‘‘বড় হাসপাতাল অনেক রোগীকে ছাড়ও দেয়। তার বদলে স্বচ্ছল রোগীদের খানিকটা ভাল পরিষেবা দিয়ে একটু বেশি টাকা নিলে ক্ষতি নেই।’’—মন্তব্য রূপালিদেবীর।

রোগী-স্বার্থে রাজ্য সরকার কোনও পদক্ষেপ করবে কি? এমন সম্ভাবনা এখনও দূর অস্ত্।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE