Advertisement
০২ মে ২০২৪

বাইরের ওষুধ কেনার জন্য চাপ, সৌজন্যে সরকারি ডাক্তাররাই

একেই বলে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! সরকারি হাসপাতালে সব পরিষেবা ‘ফ্রি’ করে দেওয়ার ব্যাপারে জোরালো ভাবে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। কিন্তু সেই কড়াকড়ির ফাঁক গলে কার্যসিদ্ধির হাজারো ছিদ্র বার করে ফেলছেন সরকারি চিকিৎসকদের একাংশ।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০০:২২
Share: Save:

একেই বলে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো!

সরকারি হাসপাতালে সব পরিষেবা ‘ফ্রি’ করে দেওয়ার ব্যাপারে জোরালো ভাবে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। কিন্তু সেই কড়াকড়ির ফাঁক গলে কার্যসিদ্ধির হাজারো ছিদ্র বার করে ফেলছেন সরকারি চিকিৎসকদের একাংশ। তাতে নাস্তানাবুদ হয়ে সম্প্রতি কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ এই ‘লুকোচুরি’-র উপাখ্যান লিখে জমা দিয়েছেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তার দফতরে। সেই সঙ্গে, কী করণীয় তা-ও জানতে চেয়েছেন।

কী রয়েছে ‘লুকোচুরি’র সেই উপাখ্যানে?

এসএসকেএম হাসপাতালের কথাই ধরা যাক। সরকার বলেছে, কোনও রোগীকে ওষুধ কেনানো যাবে না। কিন্তু তাতে কী? জব্বর ফর্মুলা বার করে ফেলেছেন সেখানকার ডাক্তারবাবুদের একাংশ। নিজেরা আর স্লিপ লিখে কারও হাতে ধরাচ্ছেন না। যদি হাতের লেখার মাধ্যমে ধরা পড়ে যান! তাই রোগীর বাড়ির লোকের হাতে সাদা কাগজ ধরিয়ে গড়গড় করে ওষুধের বানান বলে যাচ্ছেন। রোগীর আত্মীয় লিখছেন এবং বাইরে থেকে কিনে আনছেন।

নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের কিছু চিকিৎসক আরও মাথা খাটিয়ে বার করেছেন নতুন পন্থা। ধরা যাক, রোগীর এমন একটা ওষুধ দরকার যা হাসপাতালের স্টোরে নেই। অভিযোগ, কর্তৃপক্ষকে সেটা না-জানিয়ে রোগীকে সহযোগী কিছু চিকিৎসা দিয়ে ফেলে রাখছেন। এমনকী, অস্ত্রোপচারও পিছিয়ে দিচ্ছেন। বাড়ির লোককে বলছেন, ‘‘ওষুধ নেই, কী করব?’’ রোগীর দুর্দশা দেখে বাড়ির লোকই উতলা হয়ে নিজেরা বাইরে থেকে তা কিনতে চাইছেন। তখন তাঁদের হাতে ওষুধের খাপ ধরিয়ে বলা হচ্ছে, ‘‘কেউ জিজ্ঞাসা করলে কিন্তু বলবেন, আমাদের না জানিয়ে স্বেচ্ছায় কিনেছেন!’’

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের একটা বড় অংশ মূলত নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ। তাঁদের অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতাও কম। অভিযোগ, সেখানে অনেক ডাক্তারই আপ্রাণ ওই রোগীদের বুঝিয়ে যাচ্ছেন, ‘‘সব ‘ফ্রি’ কেবল কথার কথা। হাসপাতালে ওষুধ না থাকলে রোগীকে কিনতেই হবে।’’


সবিস্তারে পড়তে ক্লিক করুন...

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ, তাঁরা ইন্ডোর-আউটডোর সর্বত্র বলে বেড়াচ্ছেন, হাসপাতালে যে ওষুধ রয়েছে তাতে একেবারেই কাজ হবে না। ফলে রোগী যদি বাঁচতে চান, তা হলে যেন বাইরে থেকে ওষুধ কেনেন।

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘সব রিপোর্টই বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ পাঠাচ্ছেন। সবিনয়ে এক শ্রেণির চিকিৎসকদের বলতে চাই, কমিশন বা যে কারণেই তাঁরা এটা করে থাকুন না কেন, বেশিদিন চলবে না। আটকানোর ফর্মুলা আমরা বার করছি। সব ফ্রি করেই ছাড়ব।’’

সরেজমিন বিষয়টি দেখতে গত মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর যাওয়া হয়েছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। সকাল তখন সাড়ে এগারোটা। ইমার্জেন্সির উল্টো দিকে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানের সামনে যাঁরা ওষুধ কিনতে ভিড় করেছেন, তাঁদের নিরানব্বই শতাংশের হাতে আউটডোর বা ইন্ডোরের টিকিট ধরা।

কেন ওষুধ কিনছেন? সরকারি হাসপাতালে রোগীর তো এখন কিছু কেনার কথা নয়!

জিজ্ঞাসা করতেই সকলের মোটামুটি এক উত্তর, ‘‘ডাক্তারবাবুই তো বললেন কিনে আনতে। বললেন, হাসপাতালে এটা নেই। কিনতে হবে।’’ দমদম এয়ারপোর্ট থেকে আসা ফরিদা খাতুন, স্তন ক্যানসার ক্লিনিকে আসা শম্পা বিশ্বাস, ডায়মন্ডহারবার থেকে স্কিন ক্লিনিকে আসা কৃষ্ণা মণ্ডল— সকলেরই এক গল্প। মুখে বলার পাশাপাশি রোগীর টিকিটে একাধিক ওষুধের পাশে ‘টিক’ চিহ্ন বা ‘গোল’ চিহ্ন বা ‘ক্রস’ চিহ্ন দিয়ে সেগুলি কিনতে বলছেন এক শ্রেণির চিকিৎসক। এই রকম বহু প্রেসক্রিপশনে আবার জেনেরিকের বদলে গোটা-গোটা করে ‘ব্র্যান্ড নেম’ও লেখা।

এই রকমই একটি প্রেসক্রিপশন পাওয়া গেল বৌবাজারের বাসিন্দা তরুণী শিরিন জাহা-র কাছে। সর্দিকাশি-র জন্য জেনারেল মেডিসিন ওপিডি-তে দেখাতে এসেছিলেন শিরিন। তাঁকে হাসপাতালের টিকিটেই দিব্যি ব্র্যান্ড নেম-এ ওষুধ লিখে বাইরে থেকে কিনতে বলে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। ন্যায্যমূল্যের দোকানে সেই ওষুধ না-পেয়ে কলেজ স্ট্রিটের এক দোকান থেকে তা কেনেন শিরিন।

আউটডোরে চিকিৎসকেরা শিরিনকে কী বলেছিলেন জানতে চাইলে ওই তরুণী বলেন, ‘‘কাগজে পড়েছি, মমতাদি সব ফ্রি করে দিয়েছেন। ডাক্তারবাবুরা ওষুধ কিনতে বলায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা তো হাসপাতাল থেকেই পাওয়ার কথা। তখন ডাক্তারবাবু জানালেন, হাসপাতালে ওই ওষুধ নেই। হাসপাতালে অন্য যে ওষুধ আছে তা খেলে অসুখ সারবে না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘পাশ থেকে আরও দুই ডাক্তারবাবু তখন বলছিলেন, ‘আমরা স্লিপে ওষুধ লিখে দিচ্ছি। সুপার-ডেপুটি সুপারকে খুঁজে ‘স্পট কোটেশন’ করে তা কিনতে সারা দিন পার হয়ে যাবে। চূড়ান্ত হেনস্থা হবেন, তখন বুঝবেন। এই জন্য উপকার করতে নেই।’’

মেডিক্যালের আউটডোরে একাধিক ঘরে মূলত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে অনেকেই জানালেন, সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের জানিয়ে দিয়েছেন, হাসপাতালে ওষুধ না থাকলে তাঁরা স্লিপ ধরিয়ে রোগীকে বাইরে থেকে কেনাতে পারেন। তা না হলে প্রতিদিন ওষুধ কেনানোর এত স্লিপ সুপার অফিসে যাবে যে টেবিল ঢাকা পড়ে যাবে।

সুপার কি সত্যিই এমন বলেছেন?

সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় অপ্রস্তুত গলায় বললেন, ‘‘এটা কি আমার পক্ষে বলা কখনও সম্ভব? আসলে একাংশ জুনিয়র ডাক্তার নিজেদের স্বার্থে ইচ্ছাকৃত ভাবে এই কথা ছড়াচ্ছে। আমরা আউটডোরে নজরদারি আরও বাড়াচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE