টাকা রয়েছে। সেই টাকার যাঁরা ন্যায্য প্রাপক, তাঁরাও চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন। তা সত্ত্বেও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর তাঁদের হাতে সময় মতো টাকা তুলে দিতে পারছে না! স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন ব্যর্থতায় খোদ স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশই উদ্বিগ্ন, বিরক্ত।
উদ্বিগ্ন হওয়ার আর একটি বড় কারণ, টাকা না-দেওয়ার এই ঘটনা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নয়। বরং তা ঘটছে খাস কলকাতা শহরের নামী মেডিক্যাল কলেজগুলিতে, ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’র মতো বহুল প্রচারিত সর্বভারতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচির ক্ষেত্রে। টাকা থাকা সত্ত্বেও কলকাতায় সদ্যপ্রসূতিদের হাতে-হাতে জননী সুরক্ষা যোজনার (জেএসওয়াই) চেক দিতে ব্যর্থ স্বাস্থ্য দফতর। ওই চেক দিতে মাসের পর মাস কাবার করে দিচ্ছে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলি। ফলে অনেক মহিলাই হাসপাতালে গিয়ে সন্তানের জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ হারাচ্ছেন বলে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যকর্তারাই।
টাকা দিতে এই দেরির কারণ কী? তা হলে কি এই গাফিলতির পিছনে অন্য রাজনীতি রয়েছে? প্রকল্পটি যেহেতু কেন্দ্রের, তাই কি টাকা ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না রাজ্য? স্বাস্থ্য দফতরের একটা বড় অংশ মনে করছে, রাজনীতি নয়, আসলে স্বাস্থ্যকর্তাদের মধ্যে মতভেদ এবং সমন্বয়ের অভাবই এর জন্য দায়ী।
এক দিকে রাজ্যের পরিবার কল্যাণ কমিশনার শিখা অধিকারী দাবি করেছেন, প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দেখাতে পারছেন না বলে বা মায়েদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকছে না বলে টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। উল্টো দিকে, রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর বক্তব্য, সব কাগজপত্র বা অ্যাকাউন্ট না-থাকলেও চেক দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। তাঁর অভিযোগ, “আসলে মেডিক্যাল কলেজগুলির কর্তাদের কর্মসংস্কৃতির অভাবই দেরির কারণ।” স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, সমস্যা কোথায় তা নিয়েই যদি এত ধন্দ থাকে, তা হলে তা শোধরানো যাবে কী ভাবে?
পশ্চিমবঙ্গে এখনও অন্তত ২১ শতাংশ মহিলার প্রসব হয় নিজের বাড়িতে। এতে মা ও শিশু উভয়েরই শারীরিক সঙ্কট, এমনকী মৃত্যুরও আশঙ্কা থাকে। মহিলারা যাতে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি হয়ে সন্তানের জন্ম দিতে আগ্রহী হন, সে জন্য ‘উৎসাহ ভাতা’ দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল জননী সুরক্ষা যোজনায়। তাই দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মায়েরা এবং দারিদ্রসীমার উপরে থাকা তফসিলি জাতি ও উপজাতির মায়েদের এই ভাতা দেওয়া শুরু হয়। গ্রামাঞ্চলে এই টাকার অঙ্কটা এক হাজার এবং শহরাঞ্চলে তা ৯০০ টাকা। সরকারি নির্দেশ ছিল, হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাওয়ার আগেই প্রসূতিকে চেক দিতে হবে।
কলকাতার সরকারি হাসপাতালে যাঁদের প্রসব হয়, তাঁদের ৯৯ শতাংশই গ্রাম থেকে আসা বা শহরের বস্তিবাসী বিপিএল তালিকাভুক্ত মহিলা বা এপিএল তালিকাভুক্ত তফসিলি জাতি-উপজাতির মহিলা। ফলে তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই জননী সুরক্ষার টাকার দাবিদার। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর থেকে পাওয়া রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলি এঁদের প্রাপ্য টাকা দিতে মাসের পর মাস ঘোরাচ্ছে। গত তিন মাসের হিসেব দেখলেই পরিস্থিতি অনেকটা স্পষ্ট হবে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রসব হয়েছে ২৫৮৪ জন মহিলার। এঁদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত চেক পেয়েছেন মোটে ২৮৫ জন। এসএসকেএম হাসপাতালে ওই তিন মাসে প্রসব হয়েছে ১১৭৮ জন মহিলার। চেক পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে সাকুল্যে ২২৫ জন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিন মাসে প্রসব হয়েছে ৩১৯৯ মহিলার। চেক দেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে মাত্র ৯৬৫ জনকে। ন্যাশনাল মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে ওই তিন মাসে ৩৫৭৯ জন মহিলার প্রসব হয়েছে। এঁদের মধ্যে চেক পেয়েছেন ১২৮৫ জন। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিন মাসে ৬০২২ জন প্রসূতির এক জনও এখনও জননী সুরক্ষার চেক হাতে পাননি।
টাকা দিতে দেরির কারণ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্তাদের মধ্যেই ধন্দের বিষয়ে বিশ্বরঞ্জন শতপথীকে প্রশ্ন করা হলে তাঁর বক্তব্য, “যদি কেউ কাগজপত্র বা অ্যাকাউন্ট নেই বলে টাকা না দিয়ে থাকেন, সেটা অন্যায়। স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সব কাগজপত্র দেখাতে না পারলেও চেক দেওয়া হবে। অ্যাকাউন্ট না থাকলেও চেক মিলবে এবং সেই চেক দিয়েই মা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন।” প্রশ্ন উঠেছে, এই তথ্যগুলি কি আদৌ গ্রামাঞ্চলে প্রচার করেছে স্বাস্থ্য দফতর? শতপথীর দাবি, প্রচারে কোনও ফাঁক নেই। তা হলে তাঁর দফতরেরই শিখা অধিকারী কাগজপত্র বা অ্যাকাউন্ট থাকার উপর জোর দিচ্ছেন কেন? শিখাদেবীর এ বার সতর্ক জবাব, “আসলে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চিকিৎসক বা নার্সদের প্রচুর অন্য কাজ থাকে, প্রসবও প্রচুর হয়। তাই হয়তো টাকা দিতে দেরি হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy