ভগ্ন বাড়িতেই চলে আইসিডিএস সেন্টার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
প্রতি ৪০ জন শিশু পিছু থাকার কথা একটি ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস (‘আইসিডিএস’) সেন্টার। অথচ প্রয়োজন সত্ত্বেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক এমন কেন্দ্র। যে ক’টি চলছে, ঠিক মতো কাজ করছে না সেগুলিও। কোনও কেন্দ্রে দু’জনের পরিবর্তে কর্মী রয়েছেন এক জন। সাইনবোর্ড না থাকায় কোনওটিকে আবার আইসিডিএস কেন্দ্র বলে বোঝারই উপায় নেই। বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিপজ্জনক বাড়িতে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে এই কেন্দ্রগুলি। সেই সঙ্গে কর্মীদের অনুপস্থিতির হার ও কাজের অনিচ্ছায় মুখ ফেরাচ্ছে পরিবারগুলিও। এমনই অভিযোগ উঠেছে কলকাতা পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের আইসিডিএস কেন্দ্রগুলি নিয়ে।
কলকাতার বৃহত্তম আস্তাকুঁড় ধাপা এই এলাকায়। পুরসভার হিসেব অনুযায়ী, অধিকাংশ বাসিন্দাই বিপিএল তালিকাভুক্ত। ই এম বাইপাসের পশ্চিমে আটটি আইসিডিএস কেন্দ্র রয়েছে। অন্য দিকে, পূর্ব দিকে রয়েছে মাত্র একটি। পূর্ব দিকেরই আর একটি, সাহেবাবাদের আইসিডিএস কেন্দ্রটি গত দেড় বছর ধরে বন্ধ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বসবাসকারী পরিবারগুলি সম্পর্কে কোনও তথ্যই রাখে না পুরসভা। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সূত্রের খবর, অনন্তবাদাল, ধাপা-দুর্গাপুর, খানাবেড়িয়া, উঁচুপোতা এলাকায় ছ’বছরের কম শিশুর সংখ্যা ৫০৩। মাঠপুকুর, বোঁইচতলা ও আরুপোতা এলাকায় রয়েছে ৪০০-৪৫০ জন শিশু। কেন্দ্রগুলি ঠিক মতো কাজ না করায় দিনের পর দিন পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অসংখ্য পরিবার।
দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মা ও শিশুদের জন্য ১৯৭৫ সালের ২ অক্টোবর শুরু হয় আইসিডিএস প্রকল্প। এই প্রকল্পের অন্তর্গত মোট ছ’টি কাজ। ছ’বছরের কম বয়সী শিশু, অন্তঃসত্ত্বা এবং দুগ্ধবতী মায়েদের জন্য রয়েছে সাপ্লিমেন্টারি নিউট্রিশন (সংযোজিত পুষ্টি), টিকাকরণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও রেফারাল সার্ভিস। ৩-৬ বছরের শিশুদের জন্য প্রি-স্কুল নন ফর্মাল এডুকেশন। ১৫-৪৫ বছরের মহিলাদের জন্য নিউট্রিশন অ্যান্ড হেল্থ এডুকেশন।
ওই এলাকায় কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জানাচ্ছে, বাইপাসের পূর্ব দিকে অনন্তবাদালে একটি মাত্র আইসিডিএস কেন্দ্রে চলে প্রি-স্কুল এডুকেশন ও সাপ্লিমেন্টারি নিউট্রিশন। পশ্চিম দিকের আটটি কেন্দ্রের কোনওটিতেই আইসিডিএস-এর অন্তর্গত সব ক’টি কাজ হয় না। সাহেবাবাদ ও খানাবেড়িয়ায় মাসের প্রথম ও তৃতীয় বুধবার স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালিত টিকাকরণের শিবির বসে। সেটিও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অথচ টিকাকরণ কেন্দ্রগুলিতে অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুদের পোলিও, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, টিবি, হাম-সহ ছ’টি রোগের টিকা দেওয়ার কথা। চিকিৎসকেরাও মানছেন, এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতের পক্ষে যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
অনন্তবাদালের বাসিন্দা সৌমেন বাউড়ির অভিযোগ, “এলাকায় ছ’বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৬৬। অথচ কেন্দ্রে নাম লেখানো রয়েছে মাত্র ৩৪টি শিশুর। টিকাকরণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রেফারাল সার্ভিসের কোনও ব্যবস্থা নেই।” হিসেব মতো, এক জন আইসিডিএস কর্মীর সঙ্গে থাকার কথা এক জন সহায়কের। অনন্তবাদালের বাসিন্দা রুক্মিণী সেনাপতির অভিযোগ, “কেন্দ্রে কর্মী মাত্র এক জন। কয়েক মাস ধরে তিনিও সপ্তাহে দু’-তিন দিনের বেশি সেন্টার খোলেন না। তাই কেউ যেতে চায় না।” ১২ গোবিন্দ খটিক রোডের আইসিডিএস কেন্দ্রটি সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা শ্যাম অগ্রবাল বলেন, “অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এমন সেন্টার খোলার অর্থ কী? যে কোনও মুহূর্তে দেওয়াল ভেঙে পড়ে বাচ্চা চাপা পড়তে পারে। এমন পরিবেশে কেন ছেলমেয়েদের পাঠাবেন বাবা-মায়েরা?”
আইসিডিএস কেন্দ্রগুলি ঠিক মতো কাজ না করার ফল হাতেনাতে পাচ্ছেন এলাকাবাসীরা। স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, উঁচুপোতা ও ধাপা-দুর্গাপুর এলাকায় ২০১২-১৩ সালে তিন জন সদ্যোজাতের মৃত্যু হয়েছে। অনন্তবাদাল, ধাপা-দুর্গাপুর, উঁচুপোতা ও খানাবেড়িয়া এলাকায় ৩০ জন শিশুর মধ্যে বাড়িতে প্রসব হয়েছে পাঁচটি ক্ষেত্রে। দু’টি ক্ষেত্রে আবার জন্মেছে মৃত শিশু। এখনই পরিষেবার উন্নতির দিকে গুরুত্ব না দিলে সংখ্যাটা আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে চিকিৎসকেরা।
সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্যের সমাজকল্যাণ, নারী ও শিশু উন্নয়নের সচিব রোশনী সেন। তিনি বলেন, “নতুন আইসিডিএস সেন্টারের জন্য ওই এলাকা থেকে কোনও আবেদন আসেনি। ওখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই ভিন্ রাজ্য থেকে এসে অস্থায়ী ভাবে বসবাস করেন। কয়েক বছর পরে তাঁরা চলে যান। ফলে তাঁদের নির্দিষ্ট ঠিকানা পুরসভার কাছে থাকে না। চাহিদা সত্ত্বেও নতুন আইসিডিএস সেন্টার না হওয়ার এটা অন্যতম কারণ।” তবে রোশনীদেবী আশ্বাস দিয়েছেন, সরকারি তরফে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy