সীমা পাল
রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে পাঁচ বছরের নিষ্ফল অপেক্ষা। স্বাস্থ্য ভবনেও তাই। এ বার নবান্নের দ্বারস্থ।
একটি ছোট অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল বরাহনগরের বাসিন্দা সীমা পালের। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ নিয়ে পাঁচ বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠান ও দফতরের দরজায় ঘুরছেন তাঁর স্বামী প্রভাত পাল। দু’জায়গা থেকেই যে নথি আনন্দবাজারের হাতে এসেছে, তাতে রাজ্যের কিছু নামী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও গাফিলতির অভিযোগেই সায় দিয়েছেন। তা-ও কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি কাউন্সিল বা স্বাস্থ্য দফতর। কেন নেয়নি, তার সদুত্তরও নেই। সুবিচারের আশা নিয়ে এ বার তাই খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ প্রভাতবাবু।
প্রভাতবাবুর অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সময়ে সীমাদেবীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ছিল ৬। রক্তচাপ ১৪০/১০০। হৃৎপিণ্ডও ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় বড় (কার্ডিওমেগ্যালি)। কিছুই স্থিতিশীল না করে হিস্টেরেকটমি হয় তাঁর। ওই পরিস্থিতিতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত যে যথাযথ ছিল না এবং হাসপাতালের তরফে আরও নজরদারি জরুরি
ছিল, তা নিয়ে একমত হয়ে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।
প্রভাতবাবু জানান, প্রতি মাসেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের চিকিৎসায় সীমাদেবীকে অবিলম্বে হিস্টেরেকটমি করাতে বলেন তেঘরিয়ার এক নার্সিংহোমের চিকিৎসক নীলাভ ভাদুড়ী। তাঁর অভিযোগ, সীমাদেবীর পরীক্ষার রিপোর্টে কিছু গোলমাল ধরা পড়লেও গুরুত্ব দেননি ওই চিকিৎসক। পাঁচ ইউনিট রক্তের ব্যবস্থা রাখতে বলেন। ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল সীমাদেবীকে দুই ইউনিট রক্ত দেওয়া হয়। পর দিন অস্ত্রোপচার করেন নীলাভবাবু। অভিযোগ, এর পরেই সীমাদেবীর অবস্থার অবনতি শুরু হয়। ২৫ তারিখ ফের রক্ত দেওয়া হয়। সামান্য রক্ত শরীরে যেতেই সীমাদেবীর শরীর কাঁপতে থাকে। বমি শুরু হয়। দ্রুত তাঁকে আইসিইউ-তে স্থানান্তরিত করা হয়। অবস্থার আরও অবনতি হলে ভর্তি করা হয় অন্য বেসরকারি হাসপাতালে। পর দিন সেখানে মৃত্যু হয় তাঁর। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির পাশাপাশি তেঘরিয়ার ওই নার্সিংহোমের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করেন প্রভাতবাবু। তাঁর আশঙ্কা, আগে থেকে আনানো রক্ত যথাযথ সংরক্ষণ হয়নি। তাই রক্ত দিতেই তাঁর স্ত্রীর অবনতি হতে শুরু করে।
অভিযোগ পেয়ে মেডিক্যাল কাউন্সিল বিশেষজ্ঞদের মতামত চায়। কাউন্সিলের নথিতে (যার প্রতিলিপি আনন্দবাজারের কাছে আছে) এক মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রী-রোগ বিভাগের প্রধান জানান, সীমাদেবীর ওই শারীরিক অবস্থায় অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত যথাযথ ছিল না। প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পরিকাঠামো নিয়েও। ইনস্টিটিউট অফ হেমাটোলজি অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন-এর তৎকালীন অধিকর্তা কাউন্সিলকে জানিয়েছেন, আগে থেকে রক্ত এনে পরের ক’দিন তা ওয়ার্ডের ফ্রিজে ছিল। সেই ফ্রিজ বিভিন্ন প্রয়োজনে খোলা হয়েছে। ফলে যথাযথ তাপমাত্রা না থাকায় রক্তের মান নষ্ট হতে পারে। এ নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্যও পেশ করেছেন তিনি।
তা হলে পাঁচ বছরে এই অভিযোগের নিষ্পত্তি হল না কেন? কাউন্সিলের সভাপতি নির্মল মাজি বলেন, ‘‘আমরা ২০১৩-এ কাউন্সিলে ক্ষমতায় এসেছি। হাজারেরও বেশি অভিযোগ ঝুলে ছিল। মাসের পর মাস শুনানি হত না। অনেক অভিযোগের নিষ্পত্তি করেছি। ১৬ জন ডাক্তারের শাস্তি হয়েছে। বেশ কিছু ডাক্তারের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে। সব মিটতে কিছু সময় তো লাগবেই।’’ স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালকে কবেই বা আমরা কিছু করতে পেরেছি! তবে ওই হাসপাতালের লাইসেন্স নবীকরণের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
অগত্যা খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ প্রভাতবাবু। তিনি বলেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী চাইলেই তার প্রয়োগ আরও জোরালো করতে পারেন। অন্যথায় ভবিষ্যতেও এমন অনেকে অকালে চলে যাবেন, সুবিচার মিলবে না।’’
নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ অভিযোগ নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। নীলাভবাবুর বক্তব্য, পাল পরিবারের আনা রক্তেই সমস্যা ছিল। তাই সীমাদেবীর অবস্থার অবনতি হয়। একে বলে অ্যাকিউট হেমোলাইটিক ট্রান্সফিউশন রিঅ্যাকশন। এটা যে কারওর সঙ্গে হতে পারত। তিনি বলেন, ‘‘অস্ত্রোপচারের আগে জরুরি সব নিয়মই মেনেছি। তবু আমার উপরে দোষ চাপানো হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy