Advertisement
০২ মে ২০২৪

পাভলভে তাকান, মমতাকে আর্জি অতিষ্ঠ রোগীদের

এর আগেও বারবারই রোগীদের দেখভাল নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। কখনও রোগিণীদের বিনা পোশাকে রাখা, কখনও বা খাবারের মান তলানিতে ঠেকে যাওয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তো বটেই। পাভলভ মানসিক হাসপাতালে এ বার বিছানা জুড়ে কিলবিল করা ছারপোকায় রাতের ঘুমটুকুও হারাতে বসেছে মেল ওয়ার্ডের রোগীদের। অথচ হুঁশ নেই কর্তৃপক্ষের।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৪ ০২:৪০
Share: Save:

এর আগেও বারবারই রোগীদের দেখভাল নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। কখনও রোগিণীদের বিনা পোশাকে রাখা, কখনও বা খাবারের মান তলানিতে ঠেকে যাওয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তো বটেই। পাভলভ মানসিক হাসপাতালে এ বার বিছানা জুড়ে কিলবিল করা ছারপোকায় রাতের ঘুমটুকুও হারাতে বসেছে মেল ওয়ার্ডের রোগীদের। অথচ হুঁশ নেই কর্তৃপক্ষের। হাসপাতালের কর্মীদেরই অভিযোগ, সমস্যা মেটানোর বদলে নির্বিকার থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছেন সুপার নিজেই। এই পরিস্থিতিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে কাতর আর্জি জানিয়েছিলেন রোগীরা। বলেছিলেন, “আর কেউ তো আমাদের দুর্দশার কথা শুনছেন না। আপনি অন্তত শুনুন।” জুলাই মাসে লেখা সেই চিঠির উত্তর অবশ্য আজও আসেনি।

ছারপোকার কামড়ে অতিষ্ঠ মেল ওয়ার্ডের রোগীরা রাতে একটির বদলে খেয়ে ফেলছেন দু’টি বা তিনটি ঘুমের ওষুধ। ঘুম আসছে না তাতেও। বাধ্য হয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়ছেন অনেকে। নোংরা, স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে রাতের পর রাত কাটিয়ে অধিকাংশই ভুগছেন অন্য নানা ধরনের অসুখে। ঠান্ডা লেগে ফুসফুসে সংক্রমণও হচ্ছে অনেকেরই। কড়া ডোজের ওষুধ খেয়েও রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে রোগীদের মানসিক উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। সকালে মাঝেমধ্যেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছেন অনেকে। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, এ ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বড় কোনও বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কথায়, “এ ভাবে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়াটা রোগীদের পক্ষে খুব ক্ষতিকর। আমরা বারবার কর্তৃপক্ষকে বলেছি, কিছু একটা করুন। কিন্তু কেউ শুনছেন না।”

মেল ওয়ার্ডের এক নার্স বলেন, “রাতে ঘুমোতে না পেরে রোগীরা ছটফট করছেন। এর প্রভাব ক্ষতিকর হতে বাধ্য। অনেকেই আমাদের কাছে একাধিক ঘুমের ওষুধ চাইছেন। তাঁদের ধারণা, বেশি ওষুধ খেলে হয়তো পোকার কামড় টের পাবেন না, ঘুমিয়ে পড়বেন। কোনও কোনও নার্স সেটা দিয়েও দিচ্ছেন। কিন্তু একাধিক ওষুধ খাওয়ার পরিণতি খুব ক্ষতিকর।”

রোগীরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে জলের অভাব। সাবানও পাওয়া যায় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। দিনের পর দিন ভাল ভাবে স্নান না করে গায়ে-মাথায় উকুন হয়ে গিয়েছে অনেকেরই। এরই পাশাপাশি ছারপোকার যৌথ আক্রমণে তাঁরা জেরবার। ছারপোকার কামড়ে গোটা গায়ে লাল দাগে ভরে গিয়েছে অনেকেরই। সারা দিন চুলকোনোর ফলে গায়ে ঘা-ও হয়ে গিয়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, দিন কয়েক আগে একটি সংস্থা এসে ছারপোকা মারার কাজ করে গিয়েছে। তার পরেও পরিস্থিতি না বদলালে তাঁরা নিরুপায়। ওয়ার্ডের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা অবশ্য অভিযোগ করেছেন, যে সংস্থার উপরে ছারপোকা মারার দায়িত্ব, তারা দিন কয়েক আগে স্প্রে করার নামে খাটের কোণে, পায়ায় স্রেফ জল ছিটিয়ে চলে গিয়েছে। ফলে পরিস্থিতি এক চুলও বদলায়নি। সংশ্লিষ্ট সংস্থা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, নিয়ম মেনেই স্প্রে করা হয়েছে। কিন্তু পাভলভের জমিতেই কিছু সমস্যা থাকায় স্প্রে করে সাময়িক ভাবে কিছু ছারপোকা মরলেও কোনও ভাবেই এই সমস্যা নির্মূল করা যায় না।

হাসপাতালে এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁরা ইতিমধ্যেই সুস্থ। কিন্তু পরিবারের কেউ ফিরিয়ে না নেওয়ায় বাধ্য হয়েই তাঁরা মানসিক হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরাই ওয়ার্ডের রোগীদের এককাট্টা করে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। গত জুলাই মাসে সেই চিঠি লেখার পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।

পাভলভে রোগীদের এমন দুর্দশা অবশ্য এই প্রথম নয়। বছর কয়েক আগে রোগিণীদের বিনা পোশাকে রাখার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় তোলপাড় শুরু হয়েছিল গোটা রাজ্যে। নিয়মিত হাসপাতালের উপরে নজরদারির জন্য কমিটি গড়ারও নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। তার পরে কিছু দিন সব কিছু নিয়মমাফিক চলেছে। তার পরে ফের যে-কে-সেই।

মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে ছারপোকার উপদ্রবের পাশাপাশি খাবারের মান নিয়েও অভিযোগ করেছেন রোগীরা। অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের চেয়ে মানসিক হাসপাতালের রোগীদের পুষ্টির চাহিদা কিছুটা বেশি। তাই নিয়ম অনুযায়ী সেখানে খাবার বাবদ বরাদ্দও বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও খাবারের মান অত্যন্ত খারাপ বলে অভিযোগ জানিয়েছেন রোগীরা। তাঁদের বক্তব্য, মাছের বদলে ডিম, আর বেশির ভাগ বরাদ্দ সময়েই নিরামিষ। মাঝেমধ্যেই ভাত থেকে দুর্গন্ধও বেরোয়। এ ভাবেই চলছে তাঁদের পথ্য। তাই অনেকেই অধার্হারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। চিঠিতে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে থাকার এই ‘নরক-যন্ত্রণা’ থেকে মুক্তির আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা।

হাসপাতালের কর্মীদের অভিযোগ, বেশির ভাগ সময়েই সুপার সুবোধরঞ্জন বিশ্বাসকে হাসপাতালে পাওয়া যায় না। বন্ধ থাকে তাঁর মোবাইলও। ফলে রোগীদের সমস্যা তাঁকে জানানোও যায় না। কর্মীদের অভিযোগ, সুপারের এই ‘নির্বিকার’ মনোভাব পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। পাভলভের এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে চাননি। এসএমএসেরও জবাব আসেনি। আর রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “এ রকম পরিস্থিতির কথা হাসপাতালের তরফে কেউ জানাননি। অবিলম্বে কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি জেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

soma mukhopadhyay pavlov mental hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE