Advertisement
১৮ মে ২০২৪
সপ্তাহ ঘুরতেই আবার বিপর্যয়

বিষাক্ত গ্যাসের শিকার নৌসেনা অফিসার

ন’দিনের মধ্যে ফের দুর্ঘটনার কবলে ভারতীয় নৌসেনার জাহাজ। মুম্বইয়ের মাজাগাঁও ডকে নির্মীয়মাণ কলকাতা ক্লাসের গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ‘আইএনএস-কলকাতা’য় গ্যাস লিক করে মৃত্যু হয়েছে এক নৌসেনা অফিসারের। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ডকের দুই কর্মী। এই নিয়ে গত সাত মাসে ১১টি দুর্ঘটনার মুখে পড়লো ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ। মৃত্যু হলো মোট ২১ জনের।

ভারতীয় নৌসেনার ডেস্ট্রয়ার। এই ধরনের জাহাজেই শুক্রবার ঘটেছে দুর্ঘটনা।

ভারতীয় নৌসেনার ডেস্ট্রয়ার। এই ধরনের জাহাজেই শুক্রবার ঘটেছে দুর্ঘটনা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪ ০৩:৪৫
Share: Save:

ন’দিনের মধ্যে ফের দুর্ঘটনার কবলে ভারতীয় নৌসেনার জাহাজ। মুম্বইয়ের মাজাগাঁও ডকে নির্মীয়মাণ কলকাতা ক্লাসের গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ‘আইএনএস-কলকাতা’য় গ্যাস লিক করে মৃত্যু হয়েছে এক নৌসেনা অফিসারের। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ডকের দুই কর্মী। এই নিয়ে গত সাত মাসে ১১টি দুর্ঘটনার মুখে পড়লো ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ। মৃত্যু হলো মোট ২১ জনের।

মাত্রই ক’দিন আগে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নৌবাহিনীর ডুবোজাহাজ ‘আইএনএস সিন্ধুরত্ন’য় দুর্ঘটনার পরে ইস্তফা দেন নৌসেনা প্রধান অ্যাডমিরাল ডি কে জোশী। নৌবাহিনীর অস্থায়ী প্রধান হন রবিন কুমার ধবন। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, নৌসেনার হাতে থাকা জাহাজগুলির রক্ষণাবেক্ষণের বেহাল দশা নিয়ে। কিন্তু তার পরেও এই দুর্ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের। প্রধান বিরোধী দল বিজেপির দাবি, কেন বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটছে, তা দেশের রাষ্ট্রপতি তথা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের তদন্ত করে দেখা উচিত। এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিও দাবি করেছে তারা।

সেনা এবং বন্দর সূত্রের খবর, আজ মাজাগাঁওয়ে নির্মীয়মাণ গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ‘আইএনএস কলকাতা’-র যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা হচ্ছিল। দুপুর পৌনে একটা নাগাদ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা পরীক্ষার সময় হঠাৎই গোলমাল দেখা দেয় কার্বন ডাই-অক্সাইড ইউনিটে। একটি কার্বন ডাই অক্সাইড সিলিন্ডারের সিল খুলে জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে গ্যাস। ঘটনাস্থলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন কম্যান্ডার কুন্তল ওয়াধওয়া এবং ডকের অন্য দুই কর্মী। ৪২ বছরের ওয়াধওয়াকে সেন্ট জর্জ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মুম্বই পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণ প্রকাশ জানিয়েছেন, ওয়াধওয়া মুম্বইয়ের কোলাবার বাসিন্দা। তাঁর পরিবারের লোকেদের খবর দেওয়া হয়েছে।

কার্বন ডাই অক্সাইড শরীরে ঢুকলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন ডকের দুই কর্মী। তাঁদের মধ্যে ৫১ বছরের আসলাম গফর কাজির জবানবন্দি দেওয়ার মতো ক্ষমতা রয়েছে বলে জানায় পুলিশ। তাই গফরের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। কী করে এই দুর্ঘটনা ঘটল, তা খতিয়ে দেখার জন্য আলাদা বোর্ড অব এনকোয়্যারি গঠন করেছে মাজাগাঁও ডক ও নৌসেনা। ‘আইএনএস কলকাতা’য় ওই দুর্ঘটনার সময়ে কোনও বিস্ফোরণ হয়নি বলে দাবি মাজাগাঁও ডকের মুখপাত্রের।

১৬৩ মিটার লম্বা এবং সাড়ে ৬ হাজার টনের যুদ্ধজাহাজ ‘আইএনএস কলকাতা’। বিমানবাহী জাহাজ এবং জলে-স্থলে যুদ্ধের উপযোগী জাহাজের (অ্যাম্ফিভিয়াস ভেসল) পরে ‘কলকাতা’ ক্লাসের এই ডেস্ট্রয়ারই নৌসেনার হাতে থাকা সবচেয়ে বড় জাহাজ। পূর্বসূরি ‘দিল্লি-ক্লাসের’ তুলনায় অনেক উন্নত ধরনের জাহাজ এটি। ২৭ মার্চ জাহাজটির আনুষ্ঠানিক ভাবে নৌসেনার হয়ে কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় জড়িয়েছে নৌসেনার একাধিক জাহাজ। গত বছর ১৪ অগস্ট মুম্বই বন্দরে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ধাক্কায় তলিয়ে যায় ডুবোজাহাজ ‘আইএনএস সিন্ধুরক্ষক’। তাতে থাকা ১৮ জন নৌসেনাই প্রাণ হারান। তার পরে জলের নীচে থাকা কোনও বস্তুতে আঘাত করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘আইএনএস বেতওয়া।” বিশাখাপত্তনমে মেরামতির সময়ে আগুন লাগে মাইনরোধী জাহাজ ‘আইএনএস কোঙ্কনে’। দুর্ঘটনায় পড়ে ‘আইএনএস ঐরাবত’ও।

২৬ ফেব্রুয়ারি মুম্বই উপকূলের কাছে আগুন লাগে ডুবোজাহাজ ‘আইএনএস সিন্ধুরত্ন’য়। প্রাণ হারান দুই নৌসেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার কপিশ মোওয়াল এবং লেফটেন্যান্ট মনোরঞ্জন কুমার। তার পরেই বিতর্কের জেরে নৈতিক দায় স্বীকার করে ইস্তফা দেন অ্যাডমিরাল ডি কে জোশী।

বার বার দুর্ঘটনায় দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হাল নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। বিরোধীরা প্রত্যাশিত ভাবেই আঙুল তুলছেন ইউপিএ সরকারের দিকে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের পাল্টা অভিযোগ, অর্থ মন্ত্রকের দেওয়া বাজেট বরাদ্দ নৌবাহিনী ঠিক ভাবে খরচ করছে না।

বিপাকে নৌসেনা

৭ মাসে ১১টি দুর্ঘটনা ২১টি মৃত্যু

আইএনএস-কলকাতা

• নৌসেনার জন্য তৈরি ডেস্ট্রয়ারের একটি শ্রেণি

• দিল্লি-ক্লাসের পরে আরও উন্নত মানের যুদ্ধজাহাজ

• ভারতীয় নৌসেনার হাতে থাকা বৃহত্তম ডেস্ট্রয়ার (এখনও কাজ শুরু করেনি)

• তৈরি হচ্ছে ওই শ্রেণির তিনটি জাহাজ কলকাতা, কোচি ও চেন্নাই

• থাকবে বিমান-বিধ্বংসী ও অন্য ক্ষেপণাস্ত্র, কামান, টর্পেডো ও ডুবোজাহাজ-ধ্বংসকারী রকেট, উন্নত সেন্সর

• ইতিমধ্যেই নানা কারণে পিছিয়েছে জাহাজ তৈরি। খরচ বেড়েছে ২২৫ শতাংশ

• ওজন সাড়ে ৬ হাজার টন

• দৈর্ঘ্য ১৬৩ মিটার

‘আইএনএস সিন্ধুরত্ন’য় দুর্ঘটনার পরে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে অ্যাডমিরাল জোশীর সরে যাওয়ার প্রশংসা করেছেন অনেকেই। কিন্তু একই সঙ্গে প্রাক্তন নৌসেনা অফিসারদের মতে, কেবল নৌসেনা প্রধান নয়, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিরও এই দায়িত্ব নেওয়া উচিত। আজ অ্যান্টনির ইস্তফার দাবি জানিয়েছে বিজেপিও।

কিন্তু বার বার এ ভাবে দুর্ঘটনাই বা ঘটছে কেন? ঘরোয়া আলোচনায় নৌসেনার শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, দীর্ঘ দিন ধরেই পুরনো জাহাজ, পরিকাঠামো বদলের জন্য চাপ দিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু কেন্দ্রের কোনও হেলদোল নেই। এক এক বার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, আর পুরো প্রক্রিয়া থমকে যায়। ফলে, শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখাই।

কিন্তু নির্মীয়মাণ জাহাজে দুর্ঘটনার কী ব্যাখ্যা? যে জাহাজটিতে এ দিন দুর্ঘটনা হয়েছে, সেটি এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে হাতেই পায়নি নৌসেনা। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে সেটির নির্মাণ নিয়ে। তা ছাড়া, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের মান এবং উপযোগিতা নিয়েও অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন আছে। ট্যাঙ্ক-সহ বহু সরঞ্জামের ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট সময় ও বাজেটের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারে না প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণ সংস্থাগুলি। তৈরি হলেও তাদের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অফিসারদের পাল্টা দাবি, কেবল পুরনো পরিকাঠামো নয়, সশস্ত্র বাহিনীর তরফে সরঞ্জামের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণেও গাফিলতি আছে। ‘আইএনএস কলকাতা’য় দুর্ঘটনা সেই গাফিলতির নির্দশন হতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

দেশে তৈরি সরঞ্জামের অভাবের জন্যই এখনও অস্ত্রশস্ত্রের জন্য বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ভারতকে। বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র বাজার ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকে সব বড় অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশই। ঐতিহাসিক ভাবে এই বাজারের সিংহ ভাগ দখল করে আছে রাশিয়া। তবে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও যে কোনও মূল্যে ভারতের বাজার দখল করতে মরিয়া। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি সরঞ্জামের উপরে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ভারতকে আরও সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ, সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উত্থান-পতন অনেক সময়েই প্রতিরক্ষা চুক্তিতে প্রভাব ফেলে। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও কম নয়। এই পরিস্থিতিতেই দেশীয় প্রযুক্তিতে দেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছিল নয়াদিল্লি।

কিন্তু সেই উদ্যোগ নিয়ে যে বড় প্রশ্ন আছে, ফের তারই ইঙ্গিত দিল ‘আইএনএস কলকাতা’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

submarine navy accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE