পেশোয়ারের হামলায় যাওয়ার আগে ছয় ঘাতক। বুধবার এদের ছবি প্রকাশ করেছে তালিবান। ছবি: এপি।
সাপ পোষার খেসারত যে দিতে হবে, বছর তিনেক আগেই ইসলামাবাদকে সে কথাটা বলেছিলেন প্রাক্তন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন। বলেছিলেন, “তুমি নিজের উঠোনে সাপ পুষবে। অথচ ভাববে, সেটা শুধু পড়শিকেই কামড়াবে, তা হয় না!”
মঙ্গলবার পেশোয়ারের সেনা স্কুলে ১৩২টি শিশুর প্রাণের মূল্য চুকিয়ে এখন সেই পুরনো কথাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে পাকিস্তানের বাতাসে। নিজের দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ বহু বারই উঠেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। প্রতিবেশী ভারত লাগাতার সরব হয়েছে এই নিয়ে। পাকিস্তানের মাটিতে ওসামা বিন লাদেনের আস্তানা গাড়া, মালালা ইউসুফজাইকে তালিবানের গুলি, পাকিস্তানে খেলতে এসে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট টিমবাসে আক্রমণ, মুম্বইয়ে ২৬/১১ হামলায় পাক জঙ্গিদের উপস্থিতি পাকিস্তানের সন্ত্রাসের আড়ত বরাবরই আন্তর্জাতিক শিরোনামে থেকেছে। বারবার পাকিস্তানকে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, সন্ত্রাসের কোনও দেশ বা সীমানা হয় না। শুধু মোদী সরকার নয়, মনমোহন জমানাতেও পাকিস্তানকে বলা হয়েছে, ভারত-বিরোধী জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ক্রমাগত মদত দিয়ে দেশে সন্ত্রাসের কারখানা গড়ে তুললে তা হবে কার্যত বারুদের স্তূপের উপরে বসে থাকার সামিল। মঙ্গলবারের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নিজের অস্ত্রই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে পাকিস্তানের দিকে।
পাকিস্তান অবশ্য চিরকাল একটাই যুক্তি দেখিয়ে এসেছে। তাদের বক্তব্য, তারা জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেয় না। বরং তারা নিজেরাই জঙ্গিদের হাতে আক্রান্ত। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের আমলে লাল মসজিদ অপারেশনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়, মনে করিয়ে দেওয়া হয় জঙ্গিদের হাতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো হত্যার ঘটনাও। করাচি-কোয়েট্টা-সোয়াট-পেশোয়ারে নাশকতার উদাহরণও অজস্র। কিন্তু ভারতের অভিযোগ হল পাকিস্তান এক দিকে যেমন জঙ্গি দমনের চেষ্টা করে, অন্য দিকে পড়শি দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বার্থে জঙ্গিদের একাংশকে উৎসাহও দেয়। পাক সেনাবাহিনী এবং গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর একাংশ জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে বলেও অভিযোগ। সে কারণেই ২৬/১১-র চক্রী হাফিজ সইদ অধরা থেকে যান। ঘটনাচক্রে এ দিন সেই হাফিজই পেশোয়ারের স্কুলে তালিবানি হামলার জন্য ভারতই দায়ী বলে তোপ দেগেছেন। এর জন্য ভারতকেই খেসারত দিতে হবে বলে হুমকিও দিয়েছেন। মুশারফও অনেকটা এক সুরে দাবি করেছেন, পাক তালিবানের মাথা ফজলুল্লা ওরফে রেডিও মোল্লা নাকি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিন্তু এই মন্তব্যের বিরোধিতা করেননি।
তবে ঘটনা হল, পেশোয়ারের স্কুলের হত্যাকাণ্ড ভারতের দীর্ঘদিনের অভিযোগকেই ফের মান্যতা দিয়েছে। বিশ্ব জুড়ে সমালোচনার মুখে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক বাহিনী। চাপ বাড়ছে দেশের মানুষের কাছ থেকেও। বিরোধী নেত্রী এবং ওয়াশিংটনে প্রাক্তন পাক দূত শেরি রহমান আজ সাফ বলেছেন, “তালিবানের প্রতি নমনীয় ছিলেন অনেক জাতীয় নেতাই। তাঁরা বক্তৃতায় কখনও তালিবান শব্দটাও উচ্চারণ করেননি। এ বার সকলের উচিত একযোগে কাজ করা।”
মঙ্গলবার সকালেও এখানেই বসে ছিল পড়ুয়ারা।
জঙ্গি-তাণ্ডবে পুড়ে খাক সেই ক্লাসঘর। বুধবার। ছবি: এএফপি।
চাপের মুখে খানিকটা তা-ই করছেনও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। পেশোয়ারের ঘটনা এক মঞ্চে এনে দিয়েছে রাজনীতির সব পক্ষকেই। তেহরিক-ই-ইনসাফ, আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টি, মুত্তাহিদা কাওয়ামি মুভমেন্ট, পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতো অনেক দলের প্রতিনিধিই আজ সর্বদল বৈঠকে যোগ দেন। সেখানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতীয় ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করে এগোনোর কথা বলেছেন শরিফ। তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রধান ইমরান খানকে আজ দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পাশের আসনে। শরিফ নিজেও বরফ গলার ইঙ্গিত দিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “ইমরানকে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তিনি ডাকলে আমিও চা খেয়ে আসব।”
সর্বদলের মঞ্চ থেকেই আজ শরিফ ঘোষণা করেন, ‘ভাল’ আর ‘খারাপ’ তালিবানের মধ্যে কোনও ফারাক করা হবে না। শেষ জঙ্গিটি খতম না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া হবে। পাক প্রধানমন্ত্রী পাশে চান সন্ত্রাসদীর্ণ পড়শি দেশ আফগানিস্তানকেও। গত কাল রাতেই নয়া আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘনিকে ফোন করেছিলেন শরিফ। সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে দু’দেশ কী ভাবে কাজ করবে, দু’জনের কথা হয় তা নিয়ে। তালিবান জঙ্গিদের উপরে চাপ তৈরি করতে দু’দেশই অভিযান শুরু করবে বলে ঠিক হয়েছে। পাক সেনাপ্রধান কাবুলে গিয়েছেন।
পাক-আফগান সীমান্তের পার্বত্য এলাকাতেই পাকিস্তানি তালিবান গোষ্ঠীর ডেরা। আল কায়দার পাশাপাশি আফগান তালিবানের সঙ্গেও এরা যোগাযোগ রেখে চলে। পাক সরকারের অভিযোগ, সীমান্ত বরাবর এই ধরনের জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করতে আফগানিস্তান যথেষ্ট সক্রিয় নয়। আবার পাকিস্তানের মাটিতে আফগান তালিবান এবং হক্কানি গোষ্ঠী নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় আফগানিস্তানও দুষেছে পাকিস্তানকে। এ বার তাঁরা পারস্পরিক দোষারোপে ইতি টেনে একযোগে কাজ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন শরিফ। পাকিস্তানে সন্ত্রাসের মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে এত দিন যে স্থগিতাদেশ ছিল, তা-ও তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy