খুন হয়ে গেল আরও এক জন, খুন হল নিলয় নীল, নীলাদ্রী চ্যাটার্জি, আরও এক বার খুন হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।
জানি, এখানেই শেষ না, হয়তো চরম শেষের এখানেই শুরু। এরপর আমি, আপনি বা অন্য কেউ। এ ভাবেই চলতে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষগুলো খুন হলে তার কোনও বিচার নেই। অনলাইন-অফলাইনে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে খুন করা হচ্ছে একের পর এক। আইসিটি আইনের বহুল আলোচিত ৫৭ ধারা শুধুই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল মানুষদের দমনের জন্য। ধর্মের নামে, জেহাদের নামে খুনি মৌলবাদী জঙ্গিদের দমনে তা কাজে আসে না। অথবা কাজে লাগানো হয় না। লাইমলাইটে যারা আছেন, তারা হুমকি পেলে তবু থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়, আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ডায়েরি হওয়ার পর দিন সাতেক খুব তৎপর থাকে পুলিশ। এমন কী মাঝ রাতে বাড়িতে গিয়ে পুলিশ ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানতে চায়- কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। আজ নীলাদ্রী খুন হওয়ার পরেও আমার বাড়ি গিয়ে পুলিশ জানতে চেয়েছে আমি এখনও বেঁচে আছি কিনা। কিন্তু ওই যে দিন সাতেক। তারপর আবার সব আগের মতোই।
আর নীলাদ্রীদের মতো লাইমলাইটে নেই যারা, তাদের তো পুলিশ ডায়েরি করার সুযোগটুকুও নেই। হ্যাঁ, নীলাদ্রীও গিয়েছিল পুলিশের কাছে। ডায়েরি না নিয়ে বরং পুলিশ তাকে দেশত্যাগের মহা-মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিল। হ্যাঁ, পুলিশের পরামর্শ মেনে নিয়েছিল নীলাদ্রী। জীবন বাঁচাতে, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর তাড়া খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে নীলাদ্রী প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে চলে যেতেই চেয়েছিল। আগামী পরশু তার জার্মানির দূতাবাসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে সেই মৃত্যুই বরণ করতে হল।
এর আগে দেশত্যাগ করেছেন অনন্য আজাদ, খুন হয়ে যাওয়া প্রিয় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের সন্তান। পুলিশ কি বলতে পারে আর কত জনকে দেশত্যাগ করাতে পারলেই এই বাংলাদেশ শান্ত হবে? শান্ত মানে তো মৌলবাদীদের আখড়া হওয়া? তবে কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে? একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছে সহযোদ্ধারা, একের পর খুন হয়ে যাচ্ছি আমরা। পুলিশের কাজ কি? ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-সহ সারা দেশে মহা-সমারোহে চলছে’ তাদের তদন্ত কাজ। জীবনের দাবিগুলো একে একে প্রায় নিঃশেষিত। তবু তদন্তের কাজ শেষ হয় না। দিন সাতেক পরে পুলিশ কর্তা আর মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করবেন- ‘এটি নিঃসন্দেহে জঙ্গিদের কাজ।’
ব্যাস, ওই পর্যন্তই। তদন্তের অগ্রগতি ওখানেই শেষ। রাষ্ট্রের দায়িত্বও শেষ। এরপর অপেক্ষা অন্য খুনের। বিচার নেই। বরং যারা বা ধরা পড়ে, মহামান্য আদালতের বদান্যতায় তারাও জামিনে মুক্ত। মুক্তি পেয়েই তাদের অন্য মিশন শুরু হয়। এই তো চলছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অপরাধ আরও আস্কারা পায়। ব্যক্তি আমি, কিংবা ব্যক্তি শোভন, অভিজিৎ, বাবু, অনন্ত, নীলাদ্রীর খুন হয়ে যাওয়া আমাকে আর ভাবায় না। কারণ জানি, যুদ্ধ করতে হলে জীবনের মায়া ত্যাগ করেই ময়দানে নামতে হয়। জীবনের মায়া ত্যাগ করেছি সেই কবেই! কিন্তু এই ব্যক্তি শোভন, অভিজিৎ, বাবু, অনন্ত, নীলাদ্রীরা মিলেই তো বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। এইসব খুনের মধ্য দিয়েই তো একটু একটু করে জীবনীশক্তি হারাচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমি। আর এই বাংলাদেশের ক্ষত-বিক্ষত শরীরের বারবার গড়িয়ে পড়া রক্তস্রোতই তো শত্রুদের সঞ্জীবনী সুধা। আমাদের খুনে ওরা শক্তিমান। বাংলাদেশ ক্রমেই দুর্বল আর শত্রুশিবিরে বিজয়ী উল্লাস। এই উল্লাস আর কত??? রক্তের খেলা এবার থামান মাননীয় সরকার বাহাদুর। এই অসহায় নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ব্যক্তি মানুষগুলোর মধ্যেই সরকার ও রাষ্ট্রের প্রাণ। তালপুকুরের ঘটির মধ্যে থাকা পাখি এই ব্যক্তি মানুষগুলোই। এই পাখিগুলোকে একে একে হত্যা করতে থাকলে সরকার, রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- সব, সব একে একে প্রাণশক্তি হারায়। সেই চূড়ান্ত মৃত্যু দেখতে চাই না। সেই দৃশ্য খুব মর্মান্তিক হবে।
(লেখক: সংগঠক, গণজাগরণ মঞ্চ)
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
ফের ব্লগার খুন বাংলাদেশে
বারবার আঘাত নামছে মুক্ত মনের উপর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy