Advertisement
১৮ মে ২০২৪
Euthanasia

সুস্মিতার স্বেচ্ছামৃত্যু: কিছু প্রশ্ন, কিছু জবাব, সঙ্গে নতুন করে মরণের অধিকারের বিতর্ক

কোন মৃত্যু স্বাভাবিক, কোনটি অস্বাভাবিক— তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে মৃত্যু কেন্দ্র করে সব আলোচনা থেকে আলাদা হয়ে রয়ে গিয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রসঙ্গ।

স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন ফিরিয়ে এনেছে সমাজকর্মী সুস্মিতা রায়চৌধুরীর মৃত্যু।

স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন ফিরিয়ে এনেছে সমাজকর্মী সুস্মিতা রায়চৌধুরীর মৃত্যু। গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১ ১৮:৩৬
Share: Save:

মৃত্যু নিয়ে কাব্য কম হয়নি। মরণের ওপারে কী আছে, তা জানার চেষ্টা এবং ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে বার বার। কোন মৃত্যু স্বাভাবিক, কোনটি অস্বাভাবিক— তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে মৃত্যু কেন্দ্র করে সব আলোচনা থেকে আলাদা হয়ে রয়ে গিয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রসঙ্গ।

নিজে মৃত্যু বরণ করা নৈতিক না অনৈতিক? কারও এমন সিদ্ধান্তে সায় দেওয়া কি ঠিক? এমন বেশ কিছু প্রশ্ন ফিরিয়ে এনেছে সমাজকর্মী সুস্মিতা রায়চৌধুরীর মৃত্যু।

গত রবিবার নিজের বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন সুস্মিতা। মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কাছের জনেদের জন্য রেখে গিয়েছেন আলাদা আলাদা বার্তা। নিজের মতো করে বিদায়ও জানিয়েছেন প্রিয়জনেদের। কিন্তু এ পদক্ষেপ নৈতিক কি না, এমন প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। সে সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আনন্দবাজার অনলাইন কথা বলেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের পরিচিত মুখেদের সঙ্গে।

যেমন মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় মনে করেন, শু‌ধু স্বাধিকারের কথা নয়, অন্য একটি জীবনবোধের কথাও সুস্মিতা বলে দিয়ে গেলেন নিজের মৃত্যুর মাধ্যমে। জীবনে আর কী বাকি আছে, সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন তিনি। সেই ভয় যে অতিক্রমও করা যায়, সুস্মিতার মৃত্যু যেন সে কথা মনে করাল। রত্নাবলীর কথায়, ‘‘যে মৃত্যুর অন্য কোনও কারণ খুঁজে পাই না, যে মৃত্যু সমাজ ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করতে পারে, সেই মৃত্যু নিয়ে আমরা ভয় পাই। সন্ত্রস্ত হই। তাই তা নিয়ে প্রশ্নও তুলি।’’

রত্নাবলী মনে করেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কী ভাবে কথা বলতে হয়, তা সুস্মিতার মতো সমাজকর্মী জানতেন। নিজের মৃত্যুর সিদ্ধান্ত দিয়ে যেন বোঝালেন সে কথাও। এই পরিচিত মনো-সমাজকর্মীর কথায়, ‘‘যে কোনও বিচ্ছেদ বা মৃত্যুই দুঃখের। সুস্মিতার মৃত্যুও তা-ই। কিন্তু যে ষাট বছর সুস্মিতা বেঁচেছিলেন, সেই সময়টা তিনি ভাল ভাবে বেঁচেছেন। নিজের যদি মনে হয় সবটা বেঁচে নিয়েছেন, তবে তা নিয়ে কি প্রশ্ন তুলতে পারি আমরা? আমাদের দেশে বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। মৃত্যুর অধিকার নিয়ে কিছু বলা হয় না কেন?’’

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার মনে করেন, এই ইচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত একটি বৃহত্তর ‘সামাজিক-রাজনৈতিক’ প্রশ্ন তুলছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি এক ধরনের স্বনির্ধারণের ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন। পাশাপাশিই তিনি মনে করছেন, একটি বয়সের পরে এক জন মানুষের সুস্থতা এবং সুরক্ষা নিয়ে সমাজকে সম্ভবত সামগ্রিক ভাবে আরও বেশি ভাবনাচিন্তার প্রয়োজনের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল সুস্মিতার এই সিদ্ধান্ত।

অনুত্তমার কথায়, ‘‘কোনও মানুষ যখন নিজের মৃত্যু নিজেই বেছে নেন, তখন কোন পরিস্থিতিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন, তার একটি ছবি আমরা তৈরি করে নেওয়ার চেষ্টা করি মাত্র। কিন্তু সেই সময়ে তাঁর মনের অবস্থান ঠিক কী রকম ছিল, তা বোঝা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সুস্মিতার লেখা ফেসবুক পোস্টটি আনন্দবাজার অনলাইনে পড়ে আমার মনে হল, যেহেতু তাঁর জন্মের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না, তাই হয়তো তিনি নিজের মৃত্যুর দিন নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন। একটি বয়সের পর কারও উপর যেন বোঝা বা ভার হতে না হয়, সেই উদ্বেগই হয়তো এই ইচ্ছামৃত্যুর পিছনে মূল কারণ হয়ে উঠেছিল।’’

পেশাদার মনোবিদ অনুত্তমা আরও বলছেন, ‘‘সুস্মিতার কোনও দীর্ঘ অসুস্থতা ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, জীবনে এই মুহূর্তে কোনও বড় মানসিক সঙ্কটের কারণও ঘটেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে এমন কোনও পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়, সেই কারণেই হয়তো তিনি ইচ্ছেমতো মৃত্যু বেছে নিয়েছেন। এতে বোঝা যায়, শুধু দীর্ঘায়ু নয়, জীবনের গুণগত মান নিয়েও কিছু মানুষ চিন্তিত।’’

কয়েক বছর আগে স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে ‘মরণ রে ইচ্ছা মৃত্যু এবং...’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল দক্ষিণ কলকাতার একটি দল। দলের অন্যতম প্রধান শ্যামলকুমার চক্রবর্তী এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই করছেন। স্বেচ্ছামৃত্যুর আইনি স্বীকৃতির পক্ষে তিনি। সুস্মিতা রায়চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনা স্বেচ্ছামৃত্যু সম্পর্কে সামাজিক ধারণার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেয় বলে মত তাঁর। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সমাজকর্মী হিসাবে সুস্মিতার এই কাজ সমাজের প্রচলিত ধারণার দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। নাট্যকর্মী হিসাবে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের একটাই বক্তব্য— এক জন মানুষের যদি নিজের ইচ্ছামতো বাঁচার অধিকার থাকে, তা হলে নিজের ইচ্ছামতো মৃত্যুর অধিকারও থাকা উচিত।’’

শ্যামলের প্রশ্ন— জীবনে বাঁচার কোনও লক্ষ্য থাকলে তবেই জীবন উপভোগ করা যায়। যখন জীবন সম্পর্কে কারও আর লক্ষ্য থাকে না, স্বপ্ন থাকে না, বিশেষত শারীরিক কারণে যদি কেউ কর্মক্ষমতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন, তা হলে তিনি ভাবতেই পারেন অন্যের সাহায্য নিয়ে আর বাঁচবেন না। যেমন আছেন, সেই অবস্থাতেই যদি তিনি জীবন সমাপ্ত করতে চান, তা হলে কি সেটা অযৌক্তিত চাওয়া?

শ্যামল অবশ্য পাশাপাশিই মনে করেন সুস্মিতার ঘটনাটি একেবারে ‘আলাদা’। সুস্মিতা অনেক বেশি মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছামৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে ভাবনার আরও অনেক রাস্তা খুলে দিয়েছে।

তবে একটি সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। শ্যামলের মতে, আইন এখনও পর্যন্ত পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর স্বীকৃতি দিয়েছে। যন্ত্রের সাহায্যে বেঁচে থাকা সেই সব মানুষ, যাঁদের জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনা নেই— তাঁদেরই এই মৃত্যুর অধিকার আছে বলা হয়েছে। প্রত্যক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। এই নাট্যকর্মীর অভিমত, ‘‘এই সময়ে খেয়াল রাখা দরকার, আইনের অপব্যবহার যেন না হয়।’’

প্রশ্ন আছে। উত্তরও। কিন্তু যে পদ্ধতিতে সুস্মিতা মৃত্যুকে ‘বরণ’ করেছেন, তা জন্ম দিল আরও একটি বিতর্কের—জীবনের অধিকার যদি থাকে তবে মৃত্যুর অধিকার কেন থাকবে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Euthanasia Right to Death Suicide psychologist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE