ফাইল চিত্র।
ক’দিনের পেটের গোলমাল, ওষুধ তো সঙ্গেই আছে। ছোট্ট করে নিজের মতো একটা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স করে নিলেই হল!
দু’দিনের জ্বরেই বা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন কী? চেনা ওষুধ তো ঘরেই আছে। আগের বার যে অ্যান্টিবায়োটিকে কমেছিল জ্বর, তিন দিন তো তা খেলেই হল!
আসলে হল না! পছন্দের বড়িতে অসুস্থতার বিপদ কাটানোর এই প্রবণতাই ডাকছে বড় বিপদ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র গবেষণায় ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে ডাক পড়েছে সচেতনতা প্রচারের। যখন-তখন ইচ্ছেমতো ওষুধ সেবনে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স’ (এএমআর) তৈরি হতে পারে। যা বাড়াচ্ছে আগামিদিনে মারাত্মক বিপদের আশঙ্কা। আর সেই বিপদের নিরিখের অন্য অনেক দেশের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে এই দেশ। চিকিৎসকেরা বলছেন, এখনই সতর্ক না হলে কয়েক বছরের মধ্যেই এমন সময় আসবে, যখন বেশ কিছু অ্যান্টিবায়োটিক কাজই করবে না কারও শরীরে। তার বিকল্প ওষুধ বার করা যাবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। যার অর্থ, বেশ কিছু রোগের চিকিৎসা করা আর সম্ভব হয়ে উঠবে না।
এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে নানা রকম ব্যবস্থা করছে ওয়াকিবহাল মহল। তেমনই একটি পদক্ষেপ হিসেবে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়ম’ এবং ‘সায়েন্স মিউজিয়ম গ্রুপ, লন্ডন’ যৌথ উদ্যোগে একটি প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেছে এই বিষয়ে। ইতিমধ্যেই লন্ডনে দেখানো হয়ে গিয়েছে সেই ‘সুপারবাগস্: দ্য ফাইট ফর আওয়ার লাইভস্’ নামে সেই প্রদর্শনী। ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়ম’-এর অধিকর্তা সমরেন্দ্র কুমার জানান, এ দেশে যা প্রদর্শিত হবে, তা লন্ডনের থেকে কিছুটা আলাদা। এখানকার পরিস্থিতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে কিছুটা আলাদা। সমস্যার গুরুত্বটা কিশোর-কিশোরীদের বোঝার মতো করে তৈরি হচ্ছে প্রদর্শনীটি। আগামী বছরের মাঝামাঝি সেটি দেখানো হবে এ শহরেও।
কী এই সুপারবাগস্?
কোনও অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহারের কারণে শরীরে সেই ওষুধের প্রতি রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ তৈরি হয়। তখন সেই ওষুধ সহজে কাজ করতে চায় না। কারণ শরীরে উপস্থিত ব্যাক্টিরিয়া তত ক্ষণে হয়ে উঠেছে রীতিমতো শক্তিশালী। অতিরিক্ত ক্ষমতাসম্পন্ন সেই জীবাণুকূলকে চিকিৎসা পরিভাষায় ‘সুপারবাগস্’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। দিন দিন বিশ্ব জুড়ে এই সুপারবাগস্-ই বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এখনই সাবধান না হলে এমন একটা সময় আসতে পারে যখন অধিকাংশ সুপারবাগ-এর সঙ্গে লড়ার মতো কোনও ওষুধই পাওয়া যাবে না। ফলে বহু রোগের থাকবে না চিকিৎসা।
বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যেই এএমআর নিয়ন্ত্রণে কড়া হয়েছে সরকার। গবেষণা চলছে এ দেশেও। তেমনই একটি গবেষণার রিপোর্ট বলছে, ইতিমধ্যেই বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। এএমআর-এর ক্ষতির নিরিখে বিশ্বের প্রথম পাঁচের মধ্যে এ দেশের নাম আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ও হু-এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের নীচের শিশুদের মৃত্যুর ২৫ শতাংশ ঘটছে নিউমোনিয়া থেকে। যা কি না সারানো যাচ্ছে না অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির কারণে। এখনই সাবধান না হলে আগামী দিনে এই সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।
বাকি দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়েই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বেড়েছে এ শহরে। মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি এতটাই কঠিন হয়ে গিয়েছে যে ইকোলাই-এর মতো আপাত সাধারণ রোগের ওষুধ দিতে গিয়েই চিন্তায় পড়তে হচ্ছে চিকিৎসকদের। তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের ইনফেকশন-এর চিকিৎসা করতে হলে আগে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা হয়, কোন কোন ওষুধ নিতে পারবে শরীর এবং কোনটা পারবে না। দিন দিন রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাতিল অ্যান্টিবায়োটিকের তালিকা লম্বা হচ্ছে। অর্থাৎ, রোগ সারানোর মতো ওষুধের সংখ্যা কমছে। এই প্রবণতাটাই মারাত্মক!’’
বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বিভিন্ন স্তরে সচেতনতা প্রয়োজন। কড়়া হওয়া দরকার সরকারেরও, যাতে যে কোনও ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। হৃদ্রোগের চিকিৎসক তাপস রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘কিছু বড় হাসপাতাল ছাড়া বেশির ভাগ জায়গাতেই সচেতনতার খুব অভাব। যেমন ইচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় অধিকাংশ জায়গায়। তার জেরেই সঙ্কট আরও গুরুতর হচ্ছে।’’ তাঁর মতে, হাসপাতাল এবং চিকিৎসকেরা সচেতন না হলে আগামী দিনে চিন্তার কারণ আরও বাড়বে। সমরেন্দ্রবাবু বলছেন, ‘‘সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা সংক্রান্ত সচেতনতা ছড়ানোর জন্যই এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy