Advertisement
১৬ মে ২০২৪
Workplace Culture

কর্মক্ষেত্রের বিষাক্ত সংস্কৃতি

কর্মক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতনের শিকার অনেকেই। এই অবস্থার মোকাবিলা সম্ভব কী ভাবে?

Sourced by the ABP

শ্রেয়া ঠাকুর
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩ ০৯:৪৬
Share: Save:

গলার শিরা ফুলিয়ে ভিডিয়ো কলে জুনিয়রদের উপর চিৎকার করছেন এক ব্যক্তি। উত্তেজনায় চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তাঁর। সেই ভিডিয়োকলে অংশগ্রহণকারী বাকিরা চুপ। ওই মানুষগুলোর মনে তখন প্রবল দ্বন্দ্ব, খারাপ লাগা... হয়তো চোখে জলও। মাসখানেক আগে সমাজমাধ্যমে এই ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়তেই মৌচাকে ঢিল পড়ার মতো জেগে উঠেছে প্রতিবাদ। প্রশ্ন উঠেছে কর্মক্ষেত্রের বিষাক্ত সংস্কৃতি নিয়ে। দিনের মধ্যে আট-দশ ঘণ্টা মানুষ কর্মক্ষেত্রে থাকেন। সেখানে যদি নির্যাতন ও বৈষম্য যোগ হয়, তবে যাপনের কাঠামোতে চিড় ধরে। যার ফল পেশাগত উদ্বেগ তথা ‘স্ট্রেস অ্যান্ড অ্যাংজ়াইটি’।

হেনস্থা নানা ভাবে হয়

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের কথায়, “কর্মক্ষেত্রে নিজের আত্মপরিচয় বারবার ধাক্কা খেলে শুরু হতে পারে উদ্বেগ ও অবসাদ। সহকর্মী ও কর্তৃপক্ষের আচরণের জন্য কেউ যদি সবসময় ভুল করার ভয়ে গুটিয়ে থাকেন তবে তা সম্ভবত বিষাক্ত কর্মসংস্কৃতির পরিচায়ক। এখান থেকেই সূচনা হয় সব কাজ নিখুঁত করার চেষ্টা, আর সেটা না হলে (সব নিখুঁত হবে, এটা ভাবা অবাস্তব) অকাতরে ভেবে যাওয়া— ওভারথিঙ্কিং।”

‘সমস্যাটা শুরু হয় কর্মীদের মানুষ না ভেবে রিসোর্স ভাবা হয় বলে,’ অকপট উত্তর সৃজনের (নাম পরিবর্তিত)। বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এই প্রযুক্তিবিদ প্রায় ১৩ বছর ধরে কর্পোরেট দুনিয়ার হালহকিকত দেখছেন। তাঁর কথায়, বহু ভাবে নির্যাতন ঘটতে পারে। যেমন, যিনি বিনা প্রতিবাদে কাজ করেন, তাঁর ঘাড়েই এসে পড়ে কাজের বোঝা। তাঁর পান থেকে চুন খসলে কথা শোনানো হয়। এ ভাবে ঘেঁটে দেওয়া যায় তাঁর কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত যাপনের ভারসাম্য। উল্টোদিকে, যিনি কাজ করছেন না, তাঁকে সচরাচর ঘাঁটানো হয় না। এটা কিন্তু সূক্ষ্ম ভাবে হওয়া নির্যাতন। এর সূচনা খানিক ‘ফেভারিটিজ়ম’ থেকে, যার ছাপ পড়ে বছর শেষের অ্যাপ্রেজ়ালে, কর্তৃপক্ষের পছন্দের লোক কাজ না করেও ভাল স্কোর পায় অনেক ক্ষেত্রে, কাজ যিনি করেন তার ঝুলি হয়তো ফাঁকা। ব্যক্তিগত অপছন্দের নিরিখে কারও কাজকে গুরুত্ব না দেওয়াও আসলে হেনস্থা। এর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের মতো বিষয় তো রয়েছেই।

বহু সংস্থায় আবার সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পাঠ দেওয়া হয়। এ ভাবে তৈরি হওয়া বিষাক্ত কর্মসংস্কৃতি অনেকাংশেই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠছে। এই চক্র ভাঙার কথা ভাবছেন কয়েক জন, সেই ‘সাইকল ব্রেকার’-এর সংখ্যা এখনও কম।

প্রসঙ্গত, কর্মক্ষেত্রে এই বিষের বাড়বাড়ন্ত কিন্তু নব্য উদারবাদের উত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত, যার প্রচ্ছন্ন আদর্শ হল স্রেফ মুনাফা বৃদ্ধি। মানুষ হয়ে উঠছেন শ্রমদানের যন্ত্র, অর্থাৎ ‘রিসোর্স।’ তার প্রতি সহমর্মিতার ভান্ডার শূন্য।

তা হলে প্রতিকার?

সৃজনের মতে, প্রযুক্তিক্ষেত্রে, যেখানে চাকরির সংখ্যা বেশি সেখানে ইস্তফা বা গণইস্তফা বড় প্রতিবাদ। কিন্তু যে ক্ষেত্রে চাকরির সংখ্যা তলানিতে বা হাই-গ্রোথ ইন্ডাস্ট্রি নয়, সেখানে বিষয়টি কঠিন।

রয়েছে সংস্থার ভূমিকাও। ক্রমান্বয়ে হেনস্থা ও বৈষম্যের প্রভাব পড়ে আক্রান্ত মানুষটির কাজে। তখন আরও চাপ না দিয়ে বরং তাঁর সমস্যার কথা জানা প্রয়োজন। এইচ আর পলিসি এমন হবে, যাতে সমস্যার কথা বলে প্রতিকার পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে, অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখার পদক্ষেপও নেয় কিছু সংস্থা। অ্যাপ্রেজ়ালে বৈষম্যের দিকে নজর রাখা প্রয়োজন। সহমর্মী হতে হবে টিমের লিড বা ম্যানেজারকেও। তাঁর দায়িত্ব এটা দেখাও যে, টিমের কেউ যেন বৈষম্যের শিকার না হন। আর তথাকথিত ‘রিসোর্স’-ই যদি ভাবা হয় কর্মীদের, তাদের অযত্নে, বিষাক্ত পরিবেশে সংস্থার কাজের মানও কি ভাল হবে?

আইনি প্রতিকার

এই দিকটি উঠে এল কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী সোহম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়:

প্র: কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন আটকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়?

উ: কর্পোরেট সংস্থাগুলির নির্দিষ্ট হিউম্যান রিসোর্স পলিসি থাকে। উক্ত আচরণ সেগুলির পরিপন্থী। সংস্থার মধ্যে থেকেই এইচ আর ডিপার্টমেন্টের সহায়তায় মোকাবিলা সম্ভব।

প্র: এই ধরনের ঘটনায় সংস্থা কি দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে?

উ: অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংস্থাগুলি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েই থাকে। ভারতীয় সংবিধান হিউম্যান ডিগনিটির যে অধিকার প্রত্যেকটি মানুষকে দিয়েছে, তা যেন লঙ্ঘিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংস্থারই।

প্র: ভাইরাল ভিডিয়োটিতে যে আচরণ দেখা গিয়েছে, তেমন আচরণের বিরুদ্ধে কী ধারায় মামলা করা যায়?

উ: মেন্টাল হ্যারাসমেন্ট নিয়ে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে আলাদা কোনও ধারা নেই। পরিস্থিতি অনুযায়ী ৫০৩ ও ৫০৪ নম্বর ধারায় আইনের দ্বারস্থ হওয়া যায়। গালিগালাজ বা আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হলে ২৯৪ নম্বর ধারাও আকৃষ্ট করা যায়। তবে, ধারাগুলি নন-কগনিজ়িবল।

প্র: হেনস্থায় কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ হলে বা আত্মঘাতী হলে কী করা উচিত?

উ: প্ররোচিত হয়ে কেউ আত্মহত্যা করলে, দণ্ডবিধির ৩০৬ নম্বর ধারায় প্ররোচকের শাস্তি হতে পারে। এই ধারাটি কগনিজ়িবল আর নন-বেলেবল, দশ বছর পর্যন্ত হাজতবাস ঘটাতে সক্ষম।

প্র: মানসিক হেনস্থার জন্য কি কোনও নিয়মবিধি রয়েছে?

উ: না। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা উদাসীন। উদাহরণ, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা অনুযায়ী আত্মহত্যার চেষ্টা ক্রিমিনাল অফেন্স ছিল দীর্ঘকাল। ২০১৭ সালে, মেন্টাল হেলথ অ্যাক্ট এসে বলেছে, কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে সরকার থেকেই তাঁর চিকিৎসা ও রিহ্যাবিলিটেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। দুঃখের বিষয়, আইন এ ক্ষেত্রে নিছক অক্ষর হয়েই থেকে গিয়েছে। কর্মক্ষেত্রে হ্যারাসমেন্ট, বুলিয়িং-এর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আইন না থাকাটা সমস্যার। মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে, এ সংক্রান্ত আইন সময়োপযোগী করতে হবে।

তবে মানসিক হেনস্থার সূত্রপাত হলে, গোড়াতেই স্পষ্ট প্রতিবাদ জরুরি। তবে দেখে নিতে হবে, নিজের আচরণে বা কাজে গলদ আছে কি না। আত্মসম্মান বিকিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, তাই শুরুতেই পদক্ষেপ শুরু করা প্রয়োজন, একা হলেও। মুখ বুজে সহ্য করলে বৈষম্য ও হেনস্থা বাড়বে বই কমবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Workplace harassment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE