অনেকের ক্ষেত্রেই গন্ধের অনুভূতি ফিরে আসতে সময় লাগছে। ছবি: শাটারস্টক
ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম-এই কথাটা বাঙালি হয়ে শোনেননি, এমন বোধ হয় কেউ নেই। কিন্তু এই ঘ্রাণশক্তিই এখন সব থেকে বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কোভিড আবহে। কারণ, কোভিডের অন্যতম উপসর্গ হিসেবে ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলার কথা বলছেন অনেকে। শুধু ঘ্রাণ কেন, ধরুন উচ্ছে ভাজা খেতে যেমন লাগছে, ঠিক তেমনই লাগছে চিকেন রোস্ট। এ তো বড় বিপজ্জনক ব্যাপার! তাহলে কী হবে, কী ভাবে এই আতঙ্ক দূর করা যাবে?
স্বাদ এবং ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলা কয়েক জনের লালারস পরীক্ষায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে বলে ব্রিটেন এবং আমেরিকার মতো দেশ মে মাসেই এই দুই উপসর্গকে করোনা সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণ বলে জানিয়ে দেয়। আমাদের দেশে যদিও জুন মাসের শেষের দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে এ জাতীয় উপসর্গের কথা বলা হয়।
স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত রায়ের মত, ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ করোনা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেই স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব পড়ে। সবটাই যে বিপজ্জনক, এমন নয়। স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব পড়ছে বলেই সেই থেকেই ঘ্রাণশক্তি কিংবা স্বাদের সমস্যা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: রাতে জেগে, দিনে ঘুম? কোভিড আবহে কতটা ক্ষতি করছেন জানেন
ঠিক কী হচ্ছে
• গন্ধ পাচ্ছেন না অনেকেই, অনেকের ক্ষেত্রেই এই অনুভূতি ফিরে আসতে সময় লাগছে। বা কেউ সেরে গিয়ে কোভিড নেগেটিভ হয়ে গন্ধের অনুভূতি ফিরে পাননি মাস দুই-তিন পরেও।
• কারও ক্ষেত্রে স্বাদের সমস্যা হচ্ছে।
• কোভিড এনকেফালাইটিসের (মস্তিষ্কের প্রদাহ) রোগী ২ থেকে ৩ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কোষ থেকে কোভিড ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। কোভিড রক্তে ছড়িয়ে পড়লে যে কোনও জায়গায় যেতে পারে, তাই প্রভাব পড়ছে মস্তিষ্কেও এবং স্নায়ুতন্ত্রে।
• কারও ক্ষেত্রে স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি হারানোর সঙ্গে সঙ্গে মাথাতেও তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: কমবে খরচ, বাড়বে সঞ্চয়, মেনে চলুন এই সব বিষয়গুলি
তা হলে এক দিন জ্বর জ্বর ভাব লাগছে, খেতে ইচ্ছে না করছে না, গন্ধ পাচ্ছেন না, সে ক্ষেত্রে কী করা উচিত?
এই প্রসঙ্গে মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বললেন, এই উপসর্গ তিন-চার দিনের বেশি স্থায়ী হলে অবশ্যই নিজেকে আইসোলেট করে রাখা উচিত। কোভিড টেস্ট করা উচিত ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। কারও কারও ক্ষেত্রে সমস্যাটা সাময়িক হলেও, অনেকের দীর্ঘকালীন ক্ষতি হচ্ছে। তাই সচেতন থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: করোনা হয়নি, প্রবল জ্বরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছি, আর কী বললেন সেরে ওঠা রোগী
স্বাদ-গন্ধ না পেলেই কি করোনা
অরিন্দমবাবু এই প্রসঙ্গে বলেন, একদমই তা নয়। গন্ধের সঙ্গে স্বাদের সমস্যাও হবে। ঘ্রাণশক্তি সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছে বেশ কিছু কোভিড কেসের ক্ষেত্রে। কারও ক্ষেত্রে নাক বন্ধ হয়ে যায় বা নাক দিয়ে জল পড়ে, সে ক্ষেত্রে শ্বাস নিতে সমস্যা হবে অন্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে। তবে তা সামান্য। এটা কিন্তু কোভিড নয়। কোভিডের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি সম্পূর্ণ চলে গেলে নাকের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রভাব পড়ছে কম। নাক দিয়ে শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে না খুব একটা।
স্বাদের অনুভূতির একটা বড় সমস্যা রয়েছে। ছবি: শাটারস্টক
এই প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, কোভিডের ক্ষেত্রে শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে যে কোনও ভাইরাল জ্বরেই স্বাদ-গন্ধ চলে যায়। শুধু স্বাদ-গন্ধ চলে গেলেই কোভিডে এমনটা নয়। সঙ্গে আরও কিছু দেখা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: ক্যানসার ঠেকাতে সঙ্গে থাকুক বিশেষ এই ফল-সব্জি
কোভিড আবহে তাহলে কী করবে মানুষ?
এখন জ্বর এলে তার সঙ্গে যদি স্বাদ-গন্ধ চলে যায়, তা হলে একটা সন্দেহের জায়গা থাকে চিকিৎসকের। তাহলে কি কোভিড হল? কিন্তু আরটিপিসিআর পরীক্ষা না করে কোনও কিছু বলা উচিত নয়। কোভিডের ক্ষেত্রে স্বাদ-গন্ধ চলে গেলে সঙ্গে একটা শুকনো কাশি হয়, নাক দিয়ে জল পড়া, এই ব্যাপারটা এখনও দেখা যায় না।
এমন কেন হয়
কোভিড ভাইরাসের ক্ষেত্রে হিস্টামিনের খুব একটা যোগ নেই। তাই শুকনো কাশিটাও থাকে একই সঙ্গে। কোষ থেকে হিস্টামিন নামে এক ধরনের রাসায়নিক ক্ষরণ হয়। এই হিস্টামিনকে কোভিড খুব একটা বিরক্ত করে না, তাই নাক দিয়ে জল পড়া ইত্যাদি খুব একটা বেশি দেখা যায় না কোভিডের ক্ষেত্রে।
শুধুমাত্র স্বাদ-গন্ধ চলে গেলেও আতঙ্ক না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন সুবর্ণবাবু। তিনি বলেন, অ্যাডেনো ভাইরাসের ক্ষেত্রে বা ফ্লু থেকেও স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি চলে যায়। তবে কোভিড চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যালি অর্থাৎ শুধুমাত্র উপসর্গ দেখে চিকিৎসার বিষয়টা শুধু নয়, পরীক্ষা করে দেখতেই হবে পজিটিভ আসছে কি না। ম্যালেরিয়ার জ্বরের ক্ষেত্রে যেমন স্বাদ-গন্ধ চলে গেল, লিভার বড়-এমন দেখা গেল আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসক ম্যালেরিয়া ধরে এগোতে পারেন তাও। কিন্তু কোভিডের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও বেশি জটিল। উপসর্গ দেখা গেলে তার পর টেস্ট করে তবেই কোভিডের চিকিৎসা করা হচ্ছে।
নাকের ভিতরে পলিপ থাকলে, কিংবা ডায়াবিটিস, অ্যালঝাইমার্স ও পার্কিনসনসের মতো অসুখ হলে অনেক সময় রোগীরা ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তা হলে?
এই প্রসঙ্গে বেলেঘাটা আইডির চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বললেন, শুধু মাত্র স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে যাওয়া নয়, কোভিডের ক্ষেত্রে আরও কোনও একটা অস্বস্তি থাকবে শরীরে। হতে পারে মাথা ব্যথা বা অল্প জ্বর। গা-হাত পা ব্যথার সঙ্গে স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি চলে যাওয়া এমনও হয়েছে কোভিডে। অনেক ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হয়েছে। তাই টানা চার পাঁচ দিন এ জাতীয় সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একটা নতুন অসুখ এটা। তাই এ নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এখনও পর্যন্ত করোনার কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায়, আপাতত অনুসন্ধানী চিকিৎসাতেই ভরসা রাখছেন চিকিৎসকরা।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy