Advertisement
২১ মে ২০২৪

কড়ি দিয়ে কেনা আত্মীয়ে ঘুচছে একাকিত্ব

দরজা খুলেই আশি ছুঁইছুঁই গৃহকর্তা একগাল হাসি নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন যুবককে। ‘‘এসো পার্টনার এসো। তোমার জন্য সেই কখন থেকে সেজেগুজে অপেক্ষা করছি! কাল আমাকে হারিয়ে দিয়েছিলে। আজ বড় হলঘরে ফুটবল রেডি করে রেখেছি। বাজি ধরে তোমাকে গোল দেব।’’

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০০:১৬
Share: Save:

দরজা খুলেই আশি ছুঁইছুঁই গৃহকর্তা একগাল হাসি নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন যুবককে। ‘‘এসো পার্টনার এসো। তোমার জন্য সেই কখন থেকে সেজেগুজে অপেক্ষা করছি! কাল আমাকে হারিয়ে দিয়েছিলে। আজ বড় হলঘরে ফুটবল রেডি করে রেখেছি। বাজি ধরে তোমাকে গোল দেব।’’ যুবকও তখন বৃদ্ধের গলা জড়িয়ে হলঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আদরভরা গলায় বলছেন, ‘‘আচ্ছা দাদুমণি, তাই হবে। তবে তোমার জন্য ল্যাংচা এনেছি, আগে সেটা খাও।’’

বৃদ্ধের নাম সব্যসাচী গুপ্ত। আইআইটি-র প্রাক্তনী। নিজের বড় ব্যবসা। লেক গার্ডেন্সের বাড়ি বিক্রি করে শরৎ ব্যানার্জি রোডের বিশাল ফ্ল্যাটে একা থাকেন। ন’ বছর আগে একমাত্র ছেলে বাবার কাছ থেকে জন্মদিনে পাওয়া মোটরবাইক থেকে পড়ে মারা গিয়েছেন, মাত্র ২২ বছর বয়সে। মেয়ে চাকরিসূত্রে ফ্লোরিডায় থাকেন। স্ত্রী মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে, মেয়ের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে বিমানে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে।

হঠাৎ করে চার দিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল নিঃসঙ্গ সব্যসাচীবাবুর। ঠিক তখনই তাঁর জলজ্যান্ত নাতি-প্রাপ্তি! নতুন করে খুঁজে পেলেন বেঁচে থাকার মানে।

প্রথম দিনই নাতির হাত ধরে গরমের দুপুরে টুপি-সানগ্লাস পরে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে গেলেন। আইসক্রিম খেলেন। বাঘ দেখলেন। ব্যাপক দোস্তি হয়ে গেল। নাতিটি বড় মিষ্টি। বছর পঁচিশ বয়স। নাম রাজ হোসেন। পকেটে করে গার্লফ্রেন্ডের ছবি এনে দাদুমণিকে দেখিয়েছেন। হলঘরে দু’জনের ফাটাফাটি ফুটবল চলে। আইপিএল নিয়ে ধুন্ধুমার তর্ক বেঁধে যায়। সপ্তাহে চার দিন দেড় ঘণ্টা করে দাদুর সঙ্গে কাটিয়ে যান নাতি।

এই নাতিকে পাওয়ার জন্য কলকাতারই একটি সংস্থাকে প্রতি দেড় ঘণ্টায় সাড়ে চারশো টাকা করে দেন দাদু সব্যসাচী। নাতি ওই সংস্থারই মাস মাইনে করা কর্মী। বদলে যাওয়া শহুরে সমাজে ক্রমশ একা হয়ে যাওয়া প্রবীণদের সঙ্গে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানোই তাঁর মতো কর্মীদের ‘কাজ।’

যৌথ পরিবার-পাড়া সংস্কৃতি লুপ্তপ্রায়। কেউ কারও খোঁজ রাখে না। সবাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। তার উপরে ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন কারণে ছিটকে গিয়েছেন দূরে। শহর-শহরতলির ঘরে-ঘরে একলা বসে জড়োসড়ো বুড়োবুড়ি। সল্টলেক, নিউ টাউন, মানিকতলা, বালিগঞ্জ, নিউ আলিপুর বা সোনারপুর—ছবিটা সর্বত্রই এক।

হাত বাড়ালে, মন চাইলে যখন অশক্ত হাতগুলো আর ছুঁতে পারছে না প্রিয়জনের হাত, তখনই এ শহরে বহু প্রবীণ টাকার বিনিময়ে সাহচর্য কিনছেন! ভাড়া করা সহচর বা সহচরীর মধ্যেই একলা বার্ধক্য খুঁজে নিতে চাইছে ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিকে। হয়তো বা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো, তবু তেতো হয়ে ওঠা জীবনে সেই ঘোলের স্বাদটুকু মন্দ লাগে না। বাড়তি সুবিধা হল, এই পরিষেবা পেতে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। নিজের বাড়ির ‘কমফর্ট জোন’ এ বসেই মেলে।

চাহিদা এমন দুর্দান্ত হলে জোগান আর ব্যবসা স্বাভাবিক। কলকাতাতেও ইতিমধ্যে এই পরিষেবার ব্যবসা শুরু করেছে ‘দীপ-প্রবীণ পরিষেবা’, ‘ট্রিবেকা কেয়ার’, ‘কেয়ার কন্টিনাম’-এর মতো অন্তত সাত-আটটি সংস্থা। তাঁরাই প্রবীণদের কাছে পাঠাচ্ছেন ‘নন-মেডিক্যাল’ কেয়ার গিভার-দের। রীতিমতো শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচার করে, ইন্টারভিউ নিয়ে এঁদের বাছাই করছে সংস্থাগুলি। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় জায়গা করে নিচ্ছে একটা নতুন পেশা।

জেরিয়াট্রিক কেয়ার বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর মতে, একাকী প্রবীণদের প্রয়োজনে ডাক্তার দেখানো, হাসপাতালে ভর্তি করা, চেক-আপের ব্যবস্থা, বাড়িতেই ভেন্টিলেটর এনে আইসিইউ তৈরি করে চিকিৎসা দেওয়ার মতো পরিষেবা আগেই চালু করেছিল একাধিক সংস্থা। কিন্তু এটাই সব নয়। প্রবীণদের মানসিক সাহচর্য প্রয়োজন বেশি, যা আয়া বা কাজের লোকের কাজ নয়। এই উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত প্রবীণদের ‘ইন্টেলেকচুয়াল কম্প্যানিয়নশিপ’ এর জন্য দরকার অন্য রকম লোক।

ইন্দ্রাণীদেবীর কথায়, ‘‘কলকাতায় এখন ছেলেমেয়ে বাইরে থাকে এমন প্রবীণের সংখ্যা এত বেশি যে, তাঁদের বিভিন্ন পরিষেবা দিতে পুরোদস্তুর ‘জেরিয়াট্রিক ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ে উঠেছে। সেখানে মেডিক্যাল কেয়ার গিভারের পাশাপাশি নন-মেডিক্যাল কেয়ার গিভারের চাহিদা প্রচুর। প্রশিক্ষণ শেষ করা মাত্র বিভিন্ন সংস্থা এঁদের ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে।’’ ইন্দ্রাণী জানান, এঁদের ন্যূনতম স্নাতক হতে হয়। হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি জানার পাশাপাশি কম্পিউটারে দক্ষতা দরকার। আর দরকার বয়স্কদের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো মানসিকতা, ধৈর্য, দরদ।

দীপ-প্রবীণ পরিষেবার অধিকর্তা শীর্ষা গুহ-র ব্যাখ্যায়, একাকী প্রবীণদের একটা ভরসা, ভালবাসা, মনের কথা ভাগ করে নেওয়ার জায়গা দরকার। এঁরা বেশির ভাগই পরিচারক-নির্ভর হয়ে কাটান। আর এঁদের অসহায়তার সুযোগ অনেকসময় অনেক পরিচারক-পরিচারিকা নেন। কেয়ার-গিভারেরা এই পরিচারকদের উপর নজরদারির কাজটাও করেন। এমন একটা ধারণা তৈরি করে দেন, যাতে পরিচারকেরা ভাবতে বাধ্য হন যে, বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা একা নন, তাঁর পিছনে কেউ আছে।

‘ট্রিবেকা কেয়ার’, ‘কেয়ার কন্টিনাম’-এর মতো একাধিক সংস্থা জানিয়েছে, প্রবীণেরা কেউ কেয়ার গিভারকে সঙ্গে নিয়ে শপিংমল, আত্মীয়ের বাড়ি, বিয়েবাড়ি যান। কেউ আবার সিনেমা দেখেন, হোটেলে খান। কেউ সঙ্গে নিয়ে ব্যাঙ্কের কাজ, পোস্ট অফিসের কাজ করেন। কেউ বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেন, তাস-দাবা খেলেন। নিজের হাতে নিত্যনতুন রান্না করে কেয়ার গিভারকে বসিয়ে খাওয়ান, শিখে নেন কী ভাবে স্কাইপ বা ফেসবুক করতে হবে। কারও আবার আব্দার, তিনি গান করবেন বা নিজের লেখা কবিতা পড়বেন আর কেয়ার গিভারকে বসে শুনতে হবে।

এ ভাবেই কখন যেন পেশাদারিত্ব ছাপিয়ে কেয়ার-গিভারদের ঠাম্মি-দাদুভাই-মাসিমা-জ্যেঠু হয়ে ওঠেন প্রবীণেরা। সমাজতাত্ত্বিক প্রদীপ বসুর কথায়, ‘‘দুঃখজনক মনে হলেও এটাই আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ। এখান থেকে ফেরা যাবে না।’’ নিজেদের জীবন দিয়ে সেটা অনুভব করেই হয়তো রিচি রোডের প্রাসাদোপম বাড়িতে একাকিনী আটাত্তর পার করা কমলেশ অগ্রবাল তাঁর কেয়ার গিভার সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতটা ধরে বলে ওঠেন, ‘‘ও এখন বাইরের কেউ নয়, আমার ঘরের ছেলে।’’ নিউ টাউনের বাসিন্দা একাত্তর বছরের গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘‘দেবাশিস (কেয়ারগিভার) না থাকলে কে আমাকে নিউ টাউন থেকে গড়িয়াহাটে শাড়ি কিনতে নিয়ে যেত? কে ইউটিউব-এ বেলাশেষে দেখাতো? ও না এলে চোখে অন্ধকার দেখি।’’

কড়ি দিয়ে কেনা হলেও অবস্থার প্রেক্ষিতে এই নির্ভরতা আর আত্মীয়তা অমূল্য!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kolkata lonliness intellectual companionship
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE