Advertisement
০২ মে ২০২৪

শরীরে ঢুকছে প্লাস্টিক-বিষ, সচেতনতা কই

কিৎসকদের মতে, প্লাস্টিকের তৈরি জলের বোতল ও শিশুদের দুধের বোতল, প্লাস্টিকের পাত্রের খাবার মাইক্রোওয়েভ অভেনে গরম করা, প্লাস্টিক মোড়কে বিক্রি হওয়া খাবার, প্রসেস্‌ড ফুড, ইনস্ট্যান্ট নুডল্স— এমন বহু জিনিসের ব্যবহার ডেকে আনছে এমন নানা রোগ।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

জয়তী রাহা
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৮ ০২:১৩
Share: Save:

পলিব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও বদলেছে এ শহরের মানসিকতা। কিন্তু, প্লাস্টিক পাত্রে রাখা পানীয় ও খাবার নিয়ে এখনও সেই সচেতনতা গড়ে ওঠেনি শহরবাসীর।

যার জেরে ধীরে ধীরে শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসার, দুর্বল হার্ট, ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি, স্নায়ুরোগের মতো সমস্যা। চিকিৎসকদের মতে, প্লাস্টিকের তৈরি জলের বোতল ও শিশুদের দুধের বোতল, প্লাস্টিকের পাত্রের খাবার মাইক্রোওয়েভ অভেনে গরম করা, প্লাস্টিক মোড়কে বিক্রি হওয়া খাবার, প্রসেস্‌ড ফুড, ইনস্ট্যান্ট নুডল্স— এমন বহু জিনিসের ব্যবহার ডেকে আনছে এমন নানা রোগ। অথচ এ নিয়ে কোনও সচেতনতা, প্রচার বা গবেষণা— কিছুই নেই।

বছরখানেক আগের ঘটনা। আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরের পাঁচটি পরিবারকে বেছে নিয়েছিলেন গবেষকেরা। তাঁদের ক্ষেত্রে বাদ দেওয়া হয় তরল বা কঠিন খাদ্যবস্তুর সংস্পর্শে থাকা প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকের পাত্র। সেই পরীক্ষার ঠিক আগে ও তিন দিন পরে প্রত্যেকের মূত্রের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

ফলাফল তুলনা করে গবেষকেরা দেখেন, পলি-কার্বনেট প্লাস্টিককে শক্ত করতে যে বিসফেনল-এ ব্যবহার করা হয়, মূত্রে তার উপস্থিতি মাত্র তিন দিনেই কমে গিয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিকের স্থিতিস্থাপকতার জন্য দায়ী উপাদান, থ্যালেট ডিইএইচপি-র পরিমাণও অর্ধেক কমেছে। কী ভাবে? গবেষকেরা বলছেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ রাখায় তা খাবারের মাধ্যমে শরীরে ঢুকতে পারেনি। ফলে এই বদল।

গবেষকদের মতে, বিসফেনল-এ নামের টক্সিক এ ক্ষেত্রে বড় ঘাতক। গরম খাবার প্লাস্টিকের সংস্পর্শে এলে ওই রাসায়নিক খাবারের সঙ্গে মেশে। এটি নিয়মিত শরীরে ঢুকলে মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোনের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে শুক্রাণু কমে যায়। হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুস এবং ত্বকও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকী, ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

শুধু এখানেই নয়, বিপদ লুকিয়ে আরও। বোতল বা পাত্র তৈরিতে ব্যবহৃত পলিভিনাইল ক্লোরাইডকে (পিভিসি) নরম করা হয় থ্যালেট ব্যবহার করে। এই পিভিসি-র একটা ইতিহাস আছে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রেলিয়ার পিভিসি কারখানার কর্মীদের মধ্যে এক সময়ে ক্যানসারের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল। ১৯৭০ সাল নাগাদ সামনে আসে পিভিসি-র এই কার্সিনোজেনেসিটি চরিত্র। থ্যালেটও অবশ্য কম যায় না। বিদেশের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শরীরে এই রাসায়নিক নিয়মিত ঢুকতে থাকলে শ্বাসকষ্ট, স্থূলতা, টাইপ ২ ডায়াবিটিস, কম বুদ্ধাঙ্ক, অটিজম, ব্রেস্ট ক্যানসারের মতো অসুখ বাসা বাঁধে।

একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় উঠে আসছে এ দেশে ক্যানসারের ভয়াবহ ছবিটা। এই রোগে আক্রান্তের দিক থেকে চিন এবং আমেরিকার পরে ভারতের স্থান। ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এ দেশে প্রতি বছর ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ৪.৫-৫ শতাংশ হারে। যদিও চিকিৎসকদের মতে, আসল ছবিটা আরও ভয়াবহ। কারণ গ্রামের পরিসংখ্যান সে ভাবে সামনেই আসে না।

গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট কিংশুক দাসের মতে, ‘‘এ সব নিয়ে কখনও মাথা ঘামানো হয় না। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ে
ভাবনা-চিন্তার সময় এসেছে। কারণ এগুলো কোষের সাইটোপ্লাজম, মাইটোকন্ড্রিয়া এবং কোষের দেওয়ালে ক্ষত তৈরি করে। লন্ডভন্ড করে দেয় শরীরের স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। দীর্ঘ বছর ধরে হওয়ায় জিনগত বদলও আসে।’’

গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট সন্দীপ পালের কথায়, “শিশুদের মধ্যে এ সবের প্রভাব পড়ে বেশি। তাই অসুখ বাসা বাঁধার আগে ঘর থেকেই সচেতন হওয়া জরুরি। মাইক্রোওয়েভ অভেনের ব্যবহার কমানো, কাচ বা স্টিলের জিনিসের ব্যবহার বাড়ানো, প্লাস্টিকের মোড়কবন্দি খাবারের কম ব্যবহারের দিক সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।”

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের অধিকর্তা তড়িৎ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য— দু’ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর এই সব রাসায়নিক। ইতিমধ্যেই জলজ জীবের মধ্যে এর কুপ্রভাব পড়ছে। যা প্রকারান্তরে বিষ খাবার হিসেবে ঢুকছে মানুষের শরীরে। তাই অবিলম্বে প্রচার, সচেতনতা, গবেষণায় জোর দেওয়া উচিত।’’

না হলে অনেক বড় বিপদ সামনে, সতর্ক করছেন চিকিৎসকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE