অবহেলার অভিযোগ উঠছিলই। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস প্রতিরোধে রাজ্য সরকার কেন সতর্ক হয়নি, এ বার সেই প্রশ্ন তুললেন ভিন্ রাজ্য থেকে আসা জীবাণুবিজ্ঞানীরাও।
পুণে ও দিল্লির জীবাণুবিজ্ঞানীরা বুধবার জলপাইগুড়িতে প্রশ্ন তোলেন, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগী তো আসছিল জানুয়ারি থেকে। তবু বাংলার স্বাস্থ্য দফতর তৎপর হয়নি কেন? তাঁদের অনুযোগ, দীর্ঘ ছ’মাস ধরে সরকারি স্তরে চূড়ান্ত উদাসীনতার জন্যই এখন, এই জুলাইয়ে এসে মারণ রোগটি এমন ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
বিষয়টি যে হাতের বাইরে চলে যেতে পারে, সেটা তাঁরা বুঝতে পারেননি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁরা মেনে নিচ্ছেন, ওই রোগের মূল বাহক কিউলেক্স বিষনোই প্রজাতির মশা খোঁজা, ভাইরাসের অন্য বাহক খুঁজে বার করার কাজ আগে থেকে শুরু করলে অনেক মানুষের জীবন বাঁচানো যেত। রোগ নির্ণয়ের যথাযথ পরিকাঠামো না-থাকাটা যে অন্যতম দুর্বলতা, সেটাও কবুল করছেন ওই স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁদের এক জনের মন্তব্য, “এ বার যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আগামী বছর যাতে আগাম ব্যবস্থা নিয়ে সংক্রমণ ঠেকানো যায়, সেই ব্যবস্থাই হচ্ছে। তার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিচ্ছি আমরা।”
পুণে ও দিল্লির জীবাণুবিজ্ঞানীদের সঙ্গে এ দিন জলপাইগুড়িতে স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারদের বৈঠকে যে-সব বিষয় উঠে এসেছে, তার মধ্যে আছে অন্তত তিনটি ‘নেই’। সেগুলি হল: i জলপাইগুড়ি জেলা এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ হওয়া সত্ত্বেও এখানে সর্বস্তরের মানুষকে এই রোগ সম্পর্কে সচেতন করা যায়নি। i জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ দেখা গেলে মানুষ কোথায় যাবেন, সেই সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই কারও। i কোথায় কোথায় রক্ত পরীক্ষা করা হয়, সেই বিষয়ে সরকারি স্তরে কোনও প্রচার নেই। আর এই সব ‘নেই’ মিলে পরিস্থিতি অনেকটাই হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।
আর এই পরিকাঠামো সংক্রান্ত বিষয়ে অভাব-অভিযোগের ময়না-তদন্ত করতে গিয়ে উঠে এসেছে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস স্টাডি সেন্টারের বিষয়টি। ১৯৮৫ সালে বর্ধমান এবং লাগোয়া বীরভূম ও বাঁকুড়ায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। রোগ ঠেকাতে তখন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জীবাণুবিজ্ঞানী বিজয় মুখোপাধ্যায়ের অধীনে ওই স্টাডি সেন্টার খোলা হয়। ওই কেন্দ্রে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্তদের রক্ত পরীক্ষা করে রিপোর্ট পাঠানো হতো কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে। নানা সমীক্ষাও হতো এনসেফালাইটিস নিয়ে। বিভিন্ন জেলায় ঘুরে এনসেফ্যালাইটিসের বাহক কিউলেক্স বিষনোই প্রজাতির মশাদের বংশবৃদ্ধি, এলাকার বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ইত্যাদি দেখা হতো। ওই বছর রোগটা কোথায় কতখানি ছড়াতে পারে, ওই সব পরীক্ষার ভিত্তিতে তার একটা ধারণা পাওয়া যেত। সেই অনুযায়ী খোলা হতো বিশেষ ওয়ার্ড।
কিন্তু মাঝখানের বেশ কয়েক বছর এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ তেমন হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে সেই কেন্দ্রটি রুগ্ণ হয়ে পড়ে। গত ন’বছর ধরে ওই কেন্দ্র বন্ধ। সেটি সক্রিয় থাকলে এ বার উত্তরবঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেকটাই সহজ হতো বলে মনে করছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারদের একাংশ। বুধবার বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষা মঞ্জুশ্রী রায় বলেন, “আমরা ঠিক করেছি, বৃহস্পতিবার মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধানকে নিয়ে একটি বৈঠক করে ফের ওই কেন্দ্র চালু করার চেষ্টা করব।”
স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এক দিকে বর্ধমানের ওই কেন্দ্র খোলা, অন্য দিকে পুণে-দিল্লির বিজ্ঞানীদের এনে সমীক্ষা চালানো দু’টি ব্যবস্থাই আগামী বছরগুলিতে জাপানি এলসেফ্যালাইটিসের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। এ দিন জলপাইগুড়িতে দু’দফায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে বাংলার স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন দিল্লি ও পুণের বিজ্ঞানীরা। স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিজ্ঞতা শুনে তাঁরা ওই বৈঠকেই বিরক্তি প্রকাশ করেন। মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের হাল দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ওই বিজ্ঞানীরা। তবে এ দিন বৈঠকের পরে বিশেষজ্ঞেরা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। পরে অবশ্য গ্রামাঞ্চলে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে একাধিক বিজ্ঞানী একান্ত আলোচনায় দুষেছেন স্বাস্থ্য দফতরের একাংশকেই।
জলপাইগুড়ির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জগন্নাথ সরকার মানছেন, রোগ প্রতিরোধ ও সচেতনতার ব্যাপারে আরও জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, “আমরা অনেক আগে থেকেই প্রচারপত্র বিলি করছি। রোগ প্রতিরোধে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।” ওই স্বাস্থ্যকর্তা জানান, বিশেষজ্ঞেরা এ দিন খোলা মনেই আলোচনা করেছেন। প্রচার যাতে জোরদার হয়, সেই জন্য নিবিড় কর্মসূচি নিতে বলেছেন তাঁরা। রোগের উৎস সম্পর্কে বাসিন্দাদের আরও সচেতন করার কথাও জানিয়েছেন। কেউ জ্বর নিয়ে এলে উপসর্গ দেখে এনসেফ্যালাইটিস সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন।
ভিন্ রাজ্যের বিজ্ঞানীরা এ দিন সকাল ১০টায় জলপাইগুড়িতে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দফতরে যান। ওই দলে ছিলেন পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির ডি ভি টন্ডন, সত্যজিৎ সেন, দোলা দাস, রহু জাকতাব এবং দিল্লির ন্যাশনাল ভেক্টর বর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের আধিকারিক কে এস আনন্দ। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের সহকারী অধিকর্তা প্রসূন অধিকারীও বৈঠকে ছিলেন। বেলা ১টা পর্যন্ত সেখানে বৈঠক হয়।
আনন্দ বেলা দেড়টা নাগাদ পৃথক ভাবে জলপাইগুড়ি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি চিকিৎসকদের বলেন, যে-হেতু এলাকাটি এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ, তাই জ্বর হলে উপসর্গ দেখে কিছুটা আঁচ পাওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে। নইলে এনসেফ্যালাইটিস হয়েছে কি না, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার আগেই রোগীর প্রাণ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। প্রাথমিক পর্যায়ে কী ধরনের ওষুধ দেওয়া উচিত, সেই ব্যাপারেও চিকিৎসকদের পরামর্শ দেন আনন্দ। রোগ নির্ণয় না-হওয়া পর্যন্ত যাতে দায়সারা চিকিৎসা না-হয়, সেই ব্যাপারেও চিকিৎসকদের আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আক্রান্তদের রক্ত পরীক্ষা করানোর উপরেও জোর দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞেরা।
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দুপুরের মধ্যে মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন আরও চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে জানুয়ারি থেকে মৃতের সংখ্যা হল ১১২। জানুয়ারিতে রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়। রোগের দাপট হুহু করে বাড়ে ৭ জুলাই থেকে। মেডিক্যাল কলেজের সুপার অমরেন্দ্র সরকার বলেন, “পরিকাঠামোর অভাব কিছুটা তো আছেই। তার মধ্যেই যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞেরা যে-পরামর্শ দিয়েছেন, তা মাথায় রেখে এগোনো হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy