Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

মাঝপথে ওষুধ ছাড়ছেন যক্ষ্মা রোগীরা, উদ্বেগ

চিকিত্‌সা শেষের আগেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেক যক্ষ্মা রোগী। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটছে, যা থেকে প্রতিরোধী যক্ষ্মার জন্ম হয় (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট)। এই প্রবণতা উদ্বেগের বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কোনও যক্ষ্মা রোগী যাতে চিকিত্‌সার মাঝপথে ওষুধ খাওয়া না ছাড়েন, সে জন্য নানা সরকারি ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ একদিন ওষুধ না খেতে এলেই বাড়িতে গিয়ে বোঝানো, প্রয়োজনে বাড়িতে গিয়ে ওষুধ খাওয়ানো বা ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

সুমন ঘোষ
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৩৫
Share: Save:

চিকিত্‌সা শেষের আগেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেক যক্ষ্মা রোগী। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটছে, যা থেকে প্রতিরোধী যক্ষ্মার জন্ম হয় (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট)। এই প্রবণতা উদ্বেগের বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কোনও যক্ষ্মা রোগী যাতে চিকিত্‌সার মাঝপথে ওষুধ খাওয়া না ছাড়েন, সে জন্য নানা সরকারি ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ একদিন ওষুধ না খেতে এলেই বাড়িতে গিয়ে বোঝানো, প্রয়োজনে বাড়িতে গিয়ে ওষুধ খাওয়ানো বা ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। যাবতীয় খরচ বহন করবে সরকার। তা সত্ত্বেও ৫০ শতাংশের বেশি যক্ষ্মা রোগীকে চিকিত্‌সা পরিষেবার আওতায় নিয়ে আসা যায়নি! সরকারি আধিকারিকদের গবেষণা বলছে, স্বাস্থ্য দফতরের উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী।

পশ্চিম মেদিনীপুরের যক্ষ্মা রোগীদের পুনরায় চিকিত্‌সার আওতায় আনতে না পারার পিছনে কী কী কারণ রয়েছে, তা জানতে গবেষণা করেছিলেন জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গি এবং ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজেনিক অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর এপিডেমোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান দেবাশিস দত্ত। গত জুলাইয়ে তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ টিউবারকুলোসিস’-এ। রিপোর্ট বলছে, ৫৭.৫ শতাংশ আক্রান্তকে পুনরায় চিকিত্‌সায় ফেরাতে কোনও স্বাস্থ্যকর্মীই বাড়িতে যাননি! কিছু ক্ষেত্রে নেহাতই রিপোর্ট করার তাগিদে দু’একজন সাধারণ কর্মী ঘুরে এসেছেন। জেলার ৮৭ জন রোগীকে নিয়ে গবেষণা চালিয়ে এই তথ্য মিলেছে। দুই গবেষকের কথায়, “রোগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই মানুষগুলি প্রতিরোধী যক্ষ্মা তৈরির বড় আধার।” বিষয়টি যে উদ্বেগের তা মানছেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরিশচন্দ্র বেরাও। তাঁর কথায়, “এ ব্যাপারে আরও বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে। কিছুতেই প্রতিরোধী যক্ষা বাড়তে দেওয়া যাবে না।” আর যাঁর উপর সংশোধিত জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ভার, সেই স্বাস্থ্য আধিকারিক শ্যামল হালদারের বক্তব্য, “তীব্র কর্মী সঙ্কট একটা বড় সমস্যা।”

স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই কর্মসূচি রূপায়ণে জেলায় ১০৬ জন কর্মী থাকার কথা। কিন্তু রয়েছেন ৬৩ জন। গুরুত্বপূর্ণ বহু পদও শূন্য। জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ। আগে ৫৫ লক্ষ জনসংখ্যা ধরে ১১টি যক্ষ্মা ইউনিট (প্রতি ৫ লক্ষ মানুষের জন্য একটি ইউনিট) চালু করা হয়েছিল। সেখানে যে ল্যাবরেটরি রয়েছে তাতে কফ ছাড়া কিছু পরীক্ষা হয় না। কিন্তু সব সময় কফ পরীক্ষা করে যক্ষ্মা নির্ণয় করা যায় না। উপযুক্ত পরিকাঠামো সব প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও নেই। ল্যাবরেটরিতেও রয়েছে কর্মী-সঙ্কট। ১১টি ইউনিটে যেখানে ৫২ জন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান থাকার কথা, সেখানে আছেন মাত্র ১৮ জন কর্মী! আবার এক-একটি পুরসভা এলাকার জন্য একজন করে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগের কথা। ৮টি পুরসভার জন্য রয়েছেন মাত্র ৪ জন স্বেচ্ছাসেবী।

ওষুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও রয়েছে সমস্যা। ওষুধ খাইয়ে রোগীদের ছাড়ার কথা উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীদের। তাই এই চিকিত্‌সা পদ্ধতির নাম ‘ডট’ (ডাইরেক্টলি অবজারভড ট্রিটমেন্ট)। কিন্তু তা হয় না। উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীদের মতে, কেন্দ্রে এসেই ওষুধ খেয়ে যাওয়ার কথা। সপ্তাহে এক দিন ওষুধ খাওয়ানোর পরে বাকি দিনের ওষুধ রোগীকে দিয়ে দেওয়া হয়। তাতেই ঘটছে বিপত্তি। যেমন ঘটেছে কেশপুরের মনতা গ্রামের শেখ রাজেশের। বাড়িতে ওষুধ নিয়ে যাওয়ার পর তা খাননি। এখন তিনি প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীতে পরিণত হয়েছেন। ২২ বছর বয়সী রাজেশের কথায়, “দু’-আড়াই বছর ধরে ওষুধ খাচ্ছি। কিছুদিন পর রোগ সেরে গিয়েছিল বলেই মনে হয়েছিল। ফলে ট্যাবলেট আর খাইনি।” কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি? রাজেশের জবাব, “উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীরা জানতে চাইলে বলতাম খেয়েছি।”

সমীক্ষার তথ্য বলছে, শহরের (১৯.৫%) থেকে গ্রামীণ (৮০.৫%) এলাকায় যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। পিছিয়ে পড়া তফসিলি জাতি (৩৪.৫%) ও উপজাতিদের (২১.৮ %) মধ্যেও আক্রান্ত অনেকে। মদ্যপানের কারণে ৩৪.৫%, বাইরে কাজে যাওয়ার জন্য ২৫.৩%, কোনও কারণ ছাড়াই ওষুধ খাবে না বলে ২০.৭%-সহ বিভিন্ন কারণে অনেকে চিকিত্‌সার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এলাকার বাইরে গেলেও যে কার্ড দেখিয়ে যে কোনও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিখরচায় এই চিকিত্‌সা পাওয়া যায়, তা-ও সকলকে বোঝানো যায়নি!

টিবি ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, ভারত যক্ষ্মা-প্রবণ দেশ। এখানে প্রতি ৩ মিনিটে ২ জন যক্ষ্মায় মারা যান। চিকিত্‌সকদের মতে, প্রতিরোধী যক্ষ্মা ঠেকানো না গেলে বিপদ বাড়বে। জেলায় প্রতিরোধী যক্ষ্মা আক্রান্ত বা সাধারণ যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা, তার পরিসংখ্যানও নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে ২০৩ জন যক্ষ্মা রোগী পাওয়া যায়। জেলায় প্রতি লক্ষে সেই সংখ্যাটা ৮৯ থেকে ১০০ জন। অনেকেই ন্যূনতম থুতু পরীক্ষাটুকু করাচ্ছেন না বলে আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতানুযায়ী, জেলায় প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১০৩ থেকে ১১৪ জন যক্ষ্মারোগীকে শনাক্তই করা যাচ্ছে না। তার মধ্যে আবার ক’জন প্রতিরোধী যক্ষ্না রোগী, তা-ও চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।

একেবারে প্রথমে ধরা পড়লে দু’ধাপে ৬ মাস (প্রথমে ২ মাস ও পরে ৪ মাস) চিকিত্‌সা করালেই রোগ সেরে যায়। ওষুধে ২৫ হাজার টাকা খরচ। কিন্তু প্রতিরোধী যক্ষ্মা হলে প্রয়োজন ‘সেকেন্ড লাইন ট্রিটমেন্টের’। তখন ওষুধেই খরচ প্রায় ৩ লক্ষ টাকা। গবেষক দেবাশিস দত্তের কথায়, “প্রথম ২-৩ মাস ওষুধ খাওয়ার পরেই শরীরে পরিবর্তন আসে। রোগীর মনে হতে থাকে রোগ সেরে গিয়েছে। চিকিত্‌সকের পরামর্শ ছাড়া যে ওষুধ বন্ধ করা যাবে না, এই সচেতনতা দরকার।” গবেষক সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গির কথায়, “শুরুতেই এই রোগ নির্মূল করা ভাল। যাতে প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগী তৈরিই না হয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

suman ghosh tb patient medinipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE