জমানো খুঁদকুড়ো এ বার শেষ হয়ে আসছে। শেষ হওয়ারই কথা, কারণ পাঁচ মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এ বার হাত পাততে হচ্ছে প্রতিবেশী পরিজনদের কাছে। তবুও প্রতিদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন নদিয়া জেলার দীপালি টিকাদার, নমিতা সিকদার, সিওয়ান জেলার পুনম তিওয়ারি, হিমাচলের দলজিৎ কুমারেরা। হয়তো পরের দিনই আসবে কোনও খবর।
শেষ ফোনে কথা হয়েছিল গত ১৫ জুন। তার পর ইরাকে বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করতে যাওয়া ৪১ জন ভারতীয় যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গিয়েছেন। আসলে ভোজবাজি নয়। ইরাকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির শিকার তাঁরা। অজ্ঞাত জঙ্গি ডেরায় এই বন্দিদের আর কণ্ঠস্বর পর্যন্ত শোনেননি তাঁদের স্ত্রী পুত্র মায়েরা। ভাসা ভাসা খবর এটুকুই যে, তাঁরা যেখানেই থাকুন বেঁচে রয়েছেন। তবে কবে ফিরবেন, বা আদৌ ফিরবেন কিনাস্পষ্ট করতে পারছে না কেন্দ্রীয় সরকারও।
সাদ্দাম হুসেনের প্রাক্তন প্রাসাদ ভেঙে ইরাকে তৈরি হচ্ছে বিরাট হাসপাতাল। সেখানে কাজ করতে গিয়েছিলেন নদিয়ার ইলশামারি এলাকার খোকন সিকদার। বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন স্ত্রী নমিতা সিকদার এবং ১৬ বছরের ছেলে ও ৬ বছরের মেয়েকে। “শেষ যখন ফোনে কথা হল, বলেছিল ওরা কম কম খেতে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দিনে তিন বার দিচ্ছে। মারধরও করছে না। তবে কোনও কথাও বলছে না। বুঝতে পারছি না ফিরতে পারব কি না”, জানাচ্ছেন গভীর আতান্তরে পড়ে যাওয়া নমিতা। “সংসারের অবস্থা শোচনীয়। আত্মীয়রা আর কত দিন টানবে? যা মনে হচ্ছে, আমার ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়াও এ বার বন্ধ হয়ে যাবে।” ইরাক থেকে ভারতীয় মুদ্রায় সংসারে মাসে দশ হাজার টাকা করে পাঠাতেন খোকন। তাতে টেনেটুনে চলে যেত সংসার। কিছু ধারও শোধ হয়েছিল। কিন্তু এ বার? নমিতার চার ননদ এই পাঁচ মাস যতটা পেরেছেন, করেছেন। বাপের বাড়ি থেকেও কিছুটা সাহায্য পেয়েছেন। কিন্তু এই অপেক্ষার শেষ কোথায় সেটাই তো জানেন না ওঁরা।
এই ৪১ জনের মধ্যে বেশিরভাগই কাজ করতেন ইরাকের ‘নুরুন আল হুদা’ নির্মাণ সংস্থায়। মে-জুন মাসে ইরাকে সে দেশের সরকার এবং আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীর লড়াইয়ের মাঝে বহু ভারতীয়ের প্রাণ বিপন্ন হয়। তাঁদের মধ্যে অনেককেই ধীরে ধীরে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় নয়াদিল্লি। কিন্তু এই ৪১ জনের উদ্ধারের কাজ এক পাও এগোয়নি। পরিস্থিতি এমনই যে এই নিয়ে মুখ খোলাও বন্ধ করে দিয়েছেন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র। অথচ সৌদি আরব থেকে সিরিয়া, ইজরায়েল-- সমস্ত দেশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে অপারেশনে। অনেকেই এগিয়ে এসেছে সাহায্যে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত লাভ কিছু হয়নি।
সম্প্রতি বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দেখা করেছিলেন ইরাকে অপহৃতদের পরিবারের সঙ্গে। তবে সেই দলে ছিলেন না পশ্চিমবঙ্গের কেউ। অপহৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই পঞ্জাবের, ফলে সে রাজ্যে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তাও বেশি। অকালি নেত্রী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরসিমরৎ কৌরের নেতৃত্বে এসেছিলেন পঞ্জাবি পরিবারগুলির সদস্যেরা। ছিল বিহারের সিওয়ানের দু’টি ও হিমাচলের একটি পরিবারও।
বিদেশমন্ত্রী তাঁদের আশ্বাস দিয়ে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছেন, “আমরা জানি যে তাঁরা বেঁচে রয়েছেন। ইরাকের যে সব লোকের কাছ থেকে আমরা খবর পাচ্ছি, তাঁরাই জানিয়েছেন এ কথা। তাঁদের কথা বিশ্বাস না করার কোনও কারণ নেই। তবে অপহৃতদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা এখনও সম্ভব হয়নি।” সুষমার কথায়, “আমরা অপহৃতদের পরিবারের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। সব রকম চেষ্টা চলছে সরকারের পক্ষ থেকে। আকাশ পাতাল এক করে আমরা খুঁজছি।”
তবে এই আশ্বাস সত্ত্বেও সুষমার সঙ্গে বৈঠকে দৃশ্যতই ভেঙে পড়েছেন নিখোঁজ ব্যক্তির নিকটাত্মীয়েরা। অনেকে নির্বাকও।
যেমন সিওয়ানের পুনম তিওয়ারি। বিদ্যাভূষণ তিওয়ারি পাঁচ মাস ধরে বন্দি আইএস-এর হাতে। শেষ বার যখন কথা বলেছিলেন স্বামীর সঙ্গে, ফোন মাঝপথে কেটে গিয়েছিল। আর আসেনি। কার্যত বোবা হয়ে গিয়েছেন পুনম। পাশে দাঁড়ানো তাঁর প্রতিবেশী অজয় জানাচ্ছেন, শেষ বার, ১৪ জুন যখন বিদ্যাভূষণ ফোনে কথা বলেছেন, তাঁর পিঠে ঠেকানো ছিল বন্দুকের নল। পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তখন। উচ্চ বর্ণের হওয়ায় অন্যের বাড়ি ঠিকে কাজ করতে যেতে পারছেন না পুনম। এই কারণেই তাঁকে দিয়ে কেউ সে সব কাজ করাবেনও না তাঁর গ্রামে। ফলে আর কিছু দিন চললে না-খেয়ে মরতে হবে মা আর বাচ্চাকে। যদি না সাদ্দাম হুসেনের দেশ থেকে ঘরে ফিরে আসতে পারেন ওই ৪১ জন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy