একজোট বিরোধীরা যতই সংসদ অচল করে রাখুক, সংস্কারের পথ থেকে কোনও ভাবেই পিছু হটতে নারাজ নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলিরা। বরং সংসদে বিল আটকে গেলেও অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা শুরু করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রী।
মোদী চাইছিলেন, সংসদের চলতি অধিবেশনে অন্তত বিমা বিলের মতো সংস্কারের একটি বিল পাশ হোক। কিন্তু রাজ্যসভায় একজোট বিরোধীদের চাপে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগামিকাল, সোমবারও ফের বিমা বিলটি পাশের জন্য তালিকাভুক্ত করেছে সরকার। কিন্তু কালও হিন্দুরাষ্ট্র, ধর্মান্তরণ-সহ একাধিক প্রশ্নে সংসদে হইচই বাধানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তৃণমূল-সহ বিরোধীরা। মমতা জানেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের প্রশ্নে বিজেপি-বিরোধী অন্য দলগুলিকে পাশে না পাওয়া গেলেও হিন্দুত্বের মতো বিষয়ে মুলায়ম, লালু-সহ একাধিক অ-বিজেপি দলের নেতাদের সমর্থন মিলবে। আগামিকালই দিল্লিতে নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদের যৌথ সভা। সেখানে মমতাকেও থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নীতীশ। মমতা দিল্লিতে না থাকায় ডেরেক ও’ব্রায়েনকে পাঠাচ্ছেন সেই সভায়। পাশাপাশি সংসদেও সরব হবে তাঁর দল। এই অবস্থায় চলতি অধিবেশনে বিমা বিল পাশের কোনও সম্ভাবনাই দেখছে না সরকার।
কিন্তু তার পরেও বসে না থেকে সংস্কারের চাকা গড়িয়ে নিয়ে যেতে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন সরকারের দু’শো দিন অতিক্রান্ত হলেও এখনও পর্যন্ত সে ভাবে বড় মাপের আর্থিক সংস্কারের পথে এগোতে পারেননি জেটলিরা। ফলে অসহিষ্ণুতার বার্তা দিতে শুরু করেছে শিল্পমহল। তারা চায়, বিমার পাশাপাশি জমি বিল, কয়লা খনি নিলাম, পণ্য-পরিষেবা করের মতো বড় ধরনের সংস্কারমুখী পদক্ষেপ করতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিক সরকার। এই অবস্থায় মোদী সরকার দ্বিমুখী কৌশল নিয়েছে। এক দিকে বিরোধী জোটের সমালোচনা করে কেন সংস্কার দরকার, তা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। অন্য দিকে সংসদের অধিবেশন শেষ হওয়ার পর অর্ডিন্যান্স জারি করে সংস্কারের প্রকল্পগুলি কার্যকর করার ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছেন মোদী-জেটলিরা।
জেটলি নিজেও সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংস্কারের যে পথে আমরা রয়েছি, সেই পথেই হাঁটতে হবে। সংস্কারের পথে যাঁরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন, তাঁদের মোকাবিলার জন্য সংবিধানে যথেষ্ট রক্ষাকবচ রয়েছে।” জেটলির মন্তব্যেই স্পষ্ট, সংসদের চলতি অধিবেশনে আর বাকি দু’দিনে যদি বিল পাশ না হয়, তা হলে অর্ডিন্যান্সের পথেই বিলগুলি আনবে সরকার। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শত বাধা উপেক্ষা করে মনমোহন সিংহ যে ভাবে পরমাণু চুক্তি করেছিলেন, মোদীও এখন সেই ধরনের কড়া পদক্ষেপ করতে চাইছেন।
কিন্তু অর্ডিন্যান্স জারির পথে সমস্যা কম নয়। সংস্কারের বিল পাশ করাতে মোদী সরকার প্রথমে যৌথ অধিবেশনের কথাও ভেবেছিল। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় অর্ডিন্যান্স করলেও ছ’মাসের মধ্যে সেটি ফের সংসদে নিয়ে এসে পাশ করাতে হবে। ঘটনা হল, বিরোধীদের সম্মিলিত বাধার মুখে সরকার এখনও রাজ্যসভায় বিমা বিলটি পাশ করাতে পারেনি। এই অবস্থায় একবার অর্ডিন্যান্সের ভিত্তিতে যদি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে এবং তার পরে সংসদে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তা হলে পুঁজি সঙ্কটের মুখে পড়বে। একই সমস্যা হতে পারে কয়লা খনি নিলাম সংক্রান্ত বিলটির ক্ষেত্রেও।
সমস্যা আরও আছে। অর্ডিন্যান্স পাশ করাতে গেলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন। নিয়ম অনুসারে, রাষ্ট্রপতি চাইলে বিলটি সরকারের কাছে ফেরত পাঠাতে পারেন। ইউপিএ জমানায় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় একবার একটি অর্ডিন্যান্স কিছু দিন আটকে রেখেছিলেন। পরে সই করলেও ক্যাবিনেট সচিবকে ডেকে সতর্ক করেন। প্রণববাবু বরাবরই চান, এ ধরনের কোনও অর্ডিন্যান্স আনার আগে সরকার যেন তাঁর সঙ্গে কথা বলে নেয়। সংবিধান অনুসারে, রাষ্ট্রপতি ফেরত পাঠানোর পর সরকার যদি আবার সেই বিলটি অনুমোদনের জন্য পাঠায়, রাষ্ট্রপতি তাতে সই করতে বাধ্য। বিজেপি সূত্র অবশ্য বলছে, এ ক্ষেত্রে এমনটা হবে না। মোদী নিজে যথেষ্টই সুসম্পর্ক বজায় রাখেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। এবং এ ধরনের কোনও অর্ডিন্যান্স আনতে হলে তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলেই এগোনোর পক্ষপাতী। আগামী মাসে বারাক ওবামার সফরের আগেই বিমা বিলে অর্ডিন্যান্স জারি করা হতে পারে। বিমা বিল নিয়ে গঠিত সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান চন্দন মিত্রের কথায়, “বিলটি রাজ্যসভায় পড়ে থাকলেও অর্ডিন্যান্স আনতে বাধা নেই।”
মোদী মন্ত্রিসভার এক সদস্যের কথায়, “সংস্কারের বিলগুলিতে কংগ্রেসের মতো বড় বিরোধী দলেরও সমর্থন রয়েছে। কিন্তু সংসদে বিজেপিকে সমর্থন করে বিরোধী শিবিরে একঘরে হতে চাইছে না তারা।” তা ছাড়া, সনিয়া গাঁধী চিকিৎসাধীন। রাহুল গাঁধী কোথায়, কেউ জানে না! ফলে কংগ্রেসও এখন দিশাহীন হয়ে গিয়েছে। বিজেপির বক্তব্য, এই অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের ত্রিশ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট ধরে রাখতে মরিয়া তিনি। একই সঙ্গে সারদা-খাগড়াগড়ের কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে জাতীয় স্তরে নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখারও তাগিদ রয়েছে মমতার। সে কারণেই সংসদে তাঁর দল এ ভাবে চলছে।
বিজেপি নেতৃত্বের ধারণা, মমতাদের এই জোট ভবিষ্যতে সংসদের বাইরে কোনও শক্তি হয়ে উঠতে পারবে না। তবে সংসদে, বিশেষ করে রাজ্যসভায় হট্টগোল করে সরকাররের সংস্কারকে আটকে দেওয়াই এই জোটের লক্ষ্য। জেটলি বলেন, “ঝাড়খণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপি সরকার গড়ার অবস্থায় যাচ্ছে। আগামী দুই বছরে যে সব রাজ্যে নির্বাচন রয়েছে, সেখানেও দলের শক্তি বাড়বে। ফলে ভবিষ্যতে রাজ্যসভার কাঁটাও দূর হবে।”
আগামী পরশু সংসদের অধিবেশন শেষ হচ্ছে। আর সে দিনই এই দুই রাজ্যের ফল ঘোষণা। দলের অভ্যন্তরীণ ও বিভিন্ন বুথ ফেরত সমীক্ষায় উজ্জীবিত বিজেপি এখন থেকেই বিরোধীদের পাল্টা চাপে ফেলার কৌশল ঠিক করে ফেলেছে। আগামিকাল হিন্দুরাষ্ট্র নিয়ে হাঙ্গামা হলে সরকারের তরফে কী বলা হবে, সেটিও ঠিক হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি তৃণমূলকে চাপে ফেলতেও তৈরি বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ আজ মোদী ও জেটলি সম্পর্কে তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের কয়েকটি মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করার পাশাপাশি ‘চিফ মিনিস্টার’ মমতাকে ‘চিট মিনিস্টার’ ও ‘চিটফান্ড মিনিস্টার’ বলে কটাক্ষও করেন।
অপেক্ষা আর দু’দিনের। সংসদের চলতি অধিবেশন শেষ হলেই পরবর্তী কৌশল নিয়ে আসরে নামবে বিজেপি। দু’ রাজ্যের বিধানসভার ফলের উপর তাদের কৌশল অনেকটাই নির্ভর করবে। তখনই স্পষ্ট হবে, অর্ডিন্যান্সের ঝুঁকি নিতে মোদী পারবেন নাকি পিছিয়ে আসবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy