Advertisement
০২ মে ২০২৪

এটিএম দুর্ভোগ আজও, চলবে আরও কয়েক দিন, মানলেন জেটলি

এ যেন এক বিঘে জমিতে দু’বালতি জল ঢালা! ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট রাতারাতি বাতিল হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার ধৈর্য ধরে ব্যাঙ্কের সামনে লাইন আরও ২-৩ সপ্তাহ লেগে যাবে এটিএমগুলির পরিষেবা স্বাভাবিক হতে।

ফাইল চিত্র। পিটিআই।

ফাইল চিত্র। পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:২৪
Share: Save:

আরও ২-৩ সপ্তাহ লেগে যাবে এটিএমগুলির পরিষেবা স্বাভাবিক হতে। শনিবার সাংবাদিক বৈঠক করে এ কথা জানালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তিনি জানান, নতুন ২০০০ টাকার নোট আসার কারণে এটিএমগুলোকে সেই ভাবে রিক্যালিব্রেট করা যায়নি। তবে সেই কাজ চলছে।

রাতারাতি নোট বাতিলের পর যে ভাবে নোট বদলের লম্বা লাইন পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলোতে। জেটলি জানান, এমন একটা পরিস্থিতিতে যে ভাবে ব্যাঙ্কের কর্মীরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিষেবা দিয়ে চলেছেন, তা প্রশংসনীয়। তিনি আরও জানান, এটা একটা বড় অভিযান। সবে তো শুরু হল। পাশাপাশি, দেশবাসীর কাছে তাঁর আবেদন ধৈর্য ধরুন, সরকারকে সহযোগিতা করুন।

শুক্রবারই স্টেট ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল এটিএমগুলোর পরিষেবা স্বাভাবিক হতে ১০ দিন সময় লাগবে। কিন্তু সেই দুর্ভোগ যে আরও বেশ কয়েক দিন পোহাতে হবে তা জেটলির কথাতেই স্পষ্ট।

এ দিকে, শনিবারেও কাটল না দুর্ভোগ। এ দিনও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এটিএমগুলিতে ঘন্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। কেউ টাকা পেয়েছেন, তো কেউ খালি হাতে ফিরে গিয়েছেন। আবার কেউ হন্যে হয়ে এক এটিএম থেকে অন্য এটিএমে দৌড়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু শুক্রবারের মতোই ছবি মিলল সর্বত্রই। কোনও এটিএমের ডিসপ্লেতে ফুটে উঠেছে ‘আউট অব সার্ভিস’, আবার কোনও এটিএমে ১০০ টাকার নোট ফুরিয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে দেশবাসীকে। বাদ যায়নি এ রাজ্যও। কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে শুক্রবারের মতো পরিস্থিতি চোখে পড়েছে। এটিএমগুলোতে গিয়ে কান পাতলেই শোনা গিয়েছে অভিযোগের পর অভিযোগ, বিক্ষোভ আর সমালোচনায় মুখর গ্রাহকেরা।

৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট রাতারাতি বাতিল হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার ধৈর্য ধরে ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ, পুরনো টাকা বদলে নতুন টাকা নেওয়ার জন্য। মেনে নিয়েছিলেন অনেক ঝঞ্ঝাট। আশা ছিল, শুক্রবার এটিএমের ঝাঁপ উঠলে পরিস্থিতি আরও খানিকটা সহনীয় হবে। ব্যাঙ্কগুলিও আশ্বাস দিয়েছিল, শাখা-লাগোয়া এটিএমগুলি তো বটেই, যত বেশি সম্ভব এটিএমের দরজা খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে এ দিন বন্ধই ছিল বেশির ভাগ এটিএম। যেগুলি খুলেছিল সেখানেও টাকা ফুরিয়ে গেল নিমেষে।

এটিএম স্বস্তি দেয়নি। ভোগান্তি চলেছে ব্যাঙ্কেও। কোথাও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বেঁধে দেওয়া সীমা পর্যন্ত টাকা তুলতে না পারার অভিযোগ উঠেছে। কোথাও সংশয় তৈরি হয়েছে নিয়মকানুন নিয়ে।

এত কিছু সত্ত্বেও আগের দিনের মতো শুক্রবারেও ভাল নম্বর নিয়ে উতরে গিয়েছেন গ্রাহকরাই।

বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা বাদে মোটের উপর ধৈর্য ধরে ব্যাঙ্ককর্মীদের সহযোগিতা করেছেন তাঁরা।

কিন্তু এটিএম এ দিন ডাহা ফেল। এ রকম হল কেন?

ব্যাঙ্ককর্তারা বলছেন, এর মূল কারণ দু’টি। প্রথমত, এত অল্প সময়ে সব এটিএম খোলার বন্দোবস্ত করা যায়নি। যে ক’টি খোলা গিয়েছে সেখানে টাকা স্রেফ উবে গিয়েছে চাহিদার সুনামিতে। কিছু জায়গায় ব্যাঙ্ক কর্মীরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ গ্রাহকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, পর্যাপ্ত সংখ্যায় ১০০ টাকার নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে না এসে পৌঁছনোর কারণেই এটিএমে এই ভোগান্তি।

কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রিন্সিপাল অ্যাডভাইজর আল্পনা কিলাওয়ালার দাবি, ‘‘টাকা জোগানের কোনও সমস্যা নেই। ব্যাঙ্কগুলিই বরং এটিএম থেকে শুধু ১০০ টাকার নোট দিয়েছে। নতুন নোট দেওয়ার ব্যবস্থা তারা করে উঠতে পারেনি। ৫০০ ও ২০০০ টাকার নতুন নোট দেওয়ার জন্য এটিএম মেশিনে কিছু পরিবর্তন করা দরকার, এবং সেই পরিবর্তন করার দায়িত্ব ব্যাঙ্কগুলিরই।’’ ব্যাঙ্কগুলি অবশ্য বলছে, মাঝের এই অল্প সময়ে ওই বন্দোবস্ত করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে বাজারে নগদের যা চাহিদা, তাতে এটিএম মেশিনে বড় নোট না-ভরা পর্যন্ত সামাল দেওয়া শক্ত। আপাতত এটিএম থেকে দিনে একটি ডেবিট কার্ডে ২০০০ টাকা পর্যন্ত তোলার অনুমতি দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। একটি মেশিন শুধু ১০০ টাকার নোটে বোঝাই করলে, মোট ২ লক্ষ টাকা ভরা যায়। তার মানে, ১০০ জন ২০০০ টাকা করে তুললেই সেই ভাঁড়ার শেষ। তার উপর এক জন গ্রাহক একাধিক কার্ড ব্যবহার করলে তো কথাই নেই। টাকা ফুরিয়ে যাবে ১০০ জনের আগেই। এ দিন এই কারণে বহু জায়গায় খোলার খানিকক্ষণের মধ্যেই এটিএম খালি হয়ে গিয়েছে। খালি এটিএম নতুন করে ভরা যায়নি অনেক জায়গায়। অন্তত দিনের বেলায় তো নয়ই। রাতে কিছু এটিএমে টাকা ভরায় রাত পর্যন্ত লাইন ছিল সল্টলেক, দমদম-সহ শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। চালু এটিএমের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছেন, এমন অনেকের দেখা মিলেছে গভীর রাতেও।

কিন্তু এটিএমে নতুন নোট ভরা গেল না কেন?

ব্যাঙ্কগুলি জানিয়েছে, তার জন্য প্রথমে এটিএম থেকে পুরনো নোট খালি করা জরুরি। অনেক জায়গায় এখনও তা সম্ভব হয়নি। ফলে সেই এটিএমগুলি চালু করা যায়নি। যেখানে পুরনো নোট খালি করা গিয়েছে, সেখানেও

নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট ভরা যায়নি এত অল্প সময়ে মেশিনের যন্ত্রাংশ ও সফটওয়্যার বদল করা সম্ভব

না হওয়ায়।


মানুষের ভিড় কামারহাটিতেও। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যভিত্তিক ব্যাঙ্কার্স কমিটির (এসএলবিসি) আহ্বায়ক মানস ধর জানান, প্রতিটি এটিএমে চারটি ক্যাসেট থাকে। এগুলি অনেকটা ট্রে বা চ্যানেলের মতো দেখতে। ওই ক্যাসেটগুলিতে রাখা নোটই গ্রাহকের হাতে আসে। পুরনো ৫০০-১০০০ এবং ১০০ টাকার নোটের উপযুক্ত মাপেই ওই ক্যাসেটগুলি তৈরি। কিন্তু নতুন ২০০০ টাকার নোটের মাপ আগের নোটগুলির থেকে আালাদা। তাই এটিএমে নতুন নোট ভরতে গেলে আগে ক্যাসেট বদলাতে হবে।

নোটের খরা

• সরকারি ভাবে এটিএম খুললেও শুক্রবার অচল বহু মেশিন

• ব্যাঙ্কের বক্তব্য, এত কম সময়ে সব মেশিনের সফটওয়্যার পাল্টানো অসম্ভব

• নতুন নোটের আয়তন পাল্টেছে, তাই বদলাতে হবে মেশিনের যন্ত্রাংশও

• কাজ চালাতে আপাতত ভরা হচ্ছে শুধু ১০০ টাকার নোট

• ১০০ টাকার নোটে মেশিনে ঢুকতে পারে ২ লক্ষ টাকা

• ২০০০ করে তুললে ১০০ জন মাত্র টাকা পাবেন

• লাগাতার ১০০ টাকা ভরতে ভরতে কাহিল ব্যাঙ্ক। তাই বসে যাচ্ছে মেশিন

• নোটের অভাবের জন্য ব্যাঙ্ক দুষছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে

• রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দাবি, নোটের কোনও অভাব নেই। ব্যর্থতার দায় ব্যাঙ্কের

ছাড় চলবে

• ছাড় দেওয়া ক্ষেত্রে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের ব্যবহার বাড়ল আরও ৭২ ঘণ্টা

• অর্থাৎ ১৪ তারিখ মধ্যরাত পর্যন্ত পুরনো নোট দেওয়া যাবে সরকারি হাসপাতালে, রেল, বিমান ও সরকারি বাসের টিকিট কেনার সময়, রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোল পাম্পে, সরকারি সমবায়িকায়, সরকারি দুধের বুথে, সরকারি বিদ্যুৎ ও জলের বিল মেটাতে, শ্মশান-কবরস্থানে

• কোর্ট ফি-ও দেওয়া যাবে পুরনো নোটে, শুক্রবার জানাল কেন্দ্র

• সমবায়িকায় পুরনো নোটে জিনিস কিনতে লাগবে পরিচয়পত্র

• পুরনো নোট চলবে না বিদ্যুৎ-জলের বাণিজ্যিক বিলে। দেওয়া যাবে না আগাম বিলও

• জাতীয় সড়কে টোল লাগবে না সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত

তা ছাড়া, বিভিন্ন অঞ্চলে নোটের চাহিদা মেপে মেশিনে তার উপযুক্ত সফ্‌টওয়্যার ভরতেও সময় লাগবে। যা দিয়ে ঠিক হবে যে এটিএমে টাকা তুললে, কোন নোট বেরোবে কতগুলি। সেই বন্দোবস্তও এখনও করা সম্ভব হয়নি ব্যাঙ্কগুলির পক্ষে।

এটিএমে দিনভর এই অসুবিধার পাশাপাশি নানা বিভ্রান্তিও ঘুরপাক খেয়েছে সারা রাজ্যে। যেমন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, চেক, টাকা তোলার স্লিপ ইত্যাদি মারফত সরাসরি ব্যাঙ্ক থেকে আপাতত দিনে তোলা যাবে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সপ্তাহে ওই সীমা ২০ হাজার টাকা। সে কথা মাথায় রেখে আগের দিন ১০ হাজার টাকা তোলার পরে শুক্রবারও ফের ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে গিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতা শীর্ষ ব্যাঙ্কের নির্দেশের সঙ্গে মেলেনি।

যেমন, এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের টালিগঞ্জ শাখায় টাকা তুলতে গিয়ে এক গ্রাহক শুনেছেন, সাপ্তাহিক ওই সীমা না কি এ দিনই কমিয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু তা নিয়ে কোনও সার্কুলার এসেছে কি? উত্তর মেলেনি। আবার এ বিষয়ে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের যোধপুর পার্ক শাখার ম্যানেজারের দাবি, পরপর দু’দিন ১০ হাজার টাকা করে তুলতে গিয়ে ব্যাঙ্কের তথ্যপ্রযুক্তি সিস্টেমেই আটকে যাচ্ছেন অনেকে। কেন? উত্তর অধরা।

টাকা না পেয়ে রাগ করেছেন কেউ কেউ। ব্যাঙ্ককর্মীরা তাঁদের বলেছেন, ‘‘নাওয়া খাওয়া ভুলতে বসেছি মশাই। আমাদের অবস্থাটাও ভাবুন।’’

কথাটা যে ফেলে দেওয়ার মতো নয়, স্টেট ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট। তারা জানিয়েছে, গোটা দেশে বৃহস্পতিবার ২২,১৫০ কোটি টাকা জমা পড়েছে তাদের কাছে। নোট পাল্টাতে হয়েছে ৭২৩ কোটির। শুক্রবার সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত এই দুই অঙ্ক যথাক্রমে ১৭,৫২৭ কোটি ও ৯৪৩ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে শুক্রবারের পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে গ্রাহকদের। এবং ব্যাঙ্কগুলিকেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ATM Fails
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE