এসপি সলবেন্দ্র সিংহ
পঠানকোট-কাণ্ডের তদন্তে নেমে বার বারই প্রশ্ন উঠেছে গুরদাসপুরের পুলিশ সুপার সলবেন্দ্র সিংহের ভূমিকা নিয়ে। নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করলেও শনিবার রাতে দুই সহযোগী-সহ জঙ্গিদের হাতে সলবেন্দ্রর অপহরণ এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তাঁর ভূমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষণ করছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সৌমিত্র রায়
১) গুরদাসপুরের মতো সীমান্তের একেবারে কাছের শহরের পুলিশ সুপার হওয়ায় সলবেন্দ্রর পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৫ জন জঙ্গি সীমান্ত পেরিয়ে রাজ্যে ঢুকেছে জেনেও কেন নিজের এলাকা ছেড়ে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে পঠানকোটে এলেন তিনি? পুলিশের কাছে খবর ছিল, জঙ্গিরা জানুয়ারির ৪ তারিখের মধ্যে সেনাছাউনি অথবা জনবহুল কোনও জায়গায় আঘাত হানতে পারে। সেই নির্দিষ্ট খবর থাকা সত্ত্বেও কেন কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে সীমান্ত থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরের একটি ধর্মস্থানে গেলেন তিনি?
২) সলবেন্দ্ররা যে ধর্মস্থানে গিয়েছিলেন, সেটি গুরুদ্বার নয়, পির মাজার। বেশ নির্জন এই মাজার যে খুব জাগ্রত, তেমন নয়। তা হলে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উজিয়ে রাত সাড়ে ৯টায় কেন তাঁরা গেলেন সেখানে?
৩) পঠানকোটে মাস ছ’য়েক আগের হামলায় জঙ্গিরা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল, এই ধর্মস্থান থেকে তার দূরত্ব বেশ কম। সেখানেই বামিয়াল এলাকায় কিছু জুতোর ছাপ মিলেছে। যা বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা বলেন, সেগুলি পাকিস্তানের ‘এপকট’ ব্র্যান্ডের জুতোর ছাপ। তদন্তকারীরা কাল জানিয়েছিলেন, পঠানকোটে হামলাকারী ৬ জঙ্গির মধ্যে এক জনের পায়ে ছিল সেই ‘এপকট’ ব্র্যান্ডেরই জুতো! তবে কি পুরনো চেনা পথে এই মাজারেই এসেছিল জঙ্গিরা?
৪) সলবেন্দ্রর দাবি, এর আগেও বেশ কয়েক বার ওই ধর্মস্থানে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু মাজারের রক্ষীর দাবি, শনিবার রাতের আগে কখনওই সেখানে যাননি তিনি। যে কোনও ধর্মস্থানের মতো এখানেও নির্দিষ্ট সময়ের বেশি খোলা থাকে না প্রধান প্রবেশপথ। সলবেন্দ্রর নির্দেশে বাধ্য হয়ে রাত পর্যন্ত তা খুলে রাখতে হয় বলে জানিয়েছেন রক্ষী। কেন?
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
ডোভালই ডোবালেন পঠানকোটে
অভিযানের নেতৃত্ব নিয়ে বেনজির সঙ্কট
সীমান্তের গুরুদ্বারে সেই রাতেই প্রথম যান এসপি
৫) কোনও অস্ত্র ছাড়া, ব্যক্তিগত রক্ষী ছাড়া অত রাতে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক জন অফিসার কেন কোথাও যাবেন? সফর যদি ব্যক্তিগত হয়ে থাকে, তা হলে নীল হুটার লাগানো সরকারি গাড়ি কেন ব্যবহার করা হল? তবে কি নিজের পদের সুবিধা নিতে এবং নিরাপত্তাকে ফাঁকি দিতে সরকারি গাড়ি নিয়েছিলেন সলবেন্দ্র?
৬) ইকাগর সিংহ নামে স্থানীয় এক জনের ইনোভা গাড়ি ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা। তার গলাকাটা দেহ পাওয়া যায় গাড়িটির কাছেই। খুব সম্ভবত গাড়িটি বিগড়ে যাওয়ায় সেটি ছাড়তে বাধ্য হয় জঙ্গিরা। ইকাগর সম্ভবত তাদের চিনে ফেলেছিলেন। তাই তাঁকে খুন হতে হয়েছে। সলবেন্দ্রর দাবি, তাঁদের তিন জনকে অপহরণ করে তাঁদের গাড়িতে করে এসেছিল জঙ্গিরা। সলবেন্দ্ররা তিন জন ছাড়াও পাঁচ জঙ্গি ছিল গাড়িতে। তাদের প্রত্যেকের কাছে ছিল ভারী ব্যাগ। এত কিছু নিয়ে এত জন লোক কী করে একটি এসইউভি গাড়িতে করে গেল?
পরবর্তী অংশ পড়তে ২-এ ক্লিক করুন
৭) সলবেন্দ্রর দাবি, তাঁদের হাত-চোখ বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চেপে রাখা হয়েছিল মাথা। কিন্তু কান তো খোলা ছিল। জঙ্গিদের যাবতীয় পরিকল্পনা তো তাঁদের জেনে যাওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে এত সহজে ছেড়ে দেওয়া হল তাঁদের? হাত বাঁধার দড়ি অথবা চোখ বাঁধার কাপড়টাই বা গেল কোথায়?
৮) তাঁদের সবার মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেছেন সলবেন্দ্ররা। তা হলে তাঁরা নিজেদের মধ্যে পরে যোগাযোগ করলেন কী করে? কাছাকাছি গ্রামে গিয়ে তাঁরা পুলিশকে খবর দেন। অর্থাত্, ঘটনার প্রায় চার ঘণ্টা পরে। এত ক্ষণ সময় লাগল কেন?
৯) সলবেন্দ্রর শরীরী ভাষা দেখে কখনওই মনে হয়নি যে তিনি জঙ্গি কবল থেকে মুক্ত হয়ে ফিরেছেন। এমনকী, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরও তিনি দিচ্ছিলেন বেশ ঘুরিয়ে।
১০) বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, সীমান্ত এলাকার বেশ কিছু পুলিশকর্তা, রাজনৈতিক নেতা বিদেশি চরদের ফাঁদে পড়ে যান। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ‘হানি ট্র্যাপ’-এ ফাঁসিয়ে তাঁদের ব্ল্যাকমেল করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তেমন কিছু হয়ে থাকতে পারে।
১১) হামলার দু’দিন আগে মোহালি থেকে দুই পাচারকারীকে ধরে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে পাকিস্তানে তৈরি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। এদের সঙ্গে এই হামলার কোনও যোগ নেই তো?
পরিশেষে একটা কথা বলতেই হয়, পুলিশ বা সেনাকর্মীরা নিয়োগের সময়ে শপথ নেন, যে কোনও অবস্থাতেই নিজের প্রাণ দিতেও পিছপা হবেন না। প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হচ্ছি, তেমন কোনও শপথের কথা কি সলবেন্দ্রর মনে ছিল? না হলে দীর্ঘদেহী পুলিশ সুপার নিজের জীবন দিয়েও হামলা রোখার চেষ্টা করতেন। তাই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন আইনের এই রক্ষকও!
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy