Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হাওয়া পরিকল্পিত পথে বইছে না, ভোটের তাড়া কমলো বিজেপি-র

ব্যাটে-বলে ঝড় তুলে উত্তরপ্রদেশে বাজিমাত করতে চেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু এখন ধরে খেলতে চাইছে তারা।

‘পরিবর্তন সভা’য় মোদী। শনিবার মোরাদাবাদে। ছবি: পিটিআই।

‘পরিবর্তন সভা’য় মোদী। শনিবার মোরাদাবাদে। ছবি: পিটিআই।

অনমিত্র সেনগুপ্ত
লখনউ শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৬
Share: Save:

ব্যাটে-বলে ঝড় তুলে উত্তরপ্রদেশে বাজিমাত করতে চেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু এখন ধরে খেলতে চাইছে তারা।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিজেপির আশা ছিল, ২৯ সেপ্টেম্বর এলওসি পেরিয়ে সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কৃতিত্ব প্রচার করে উত্তরপ্রদেশে ভোট বৈতরণী পার হবে। তাই তারা তখন চেয়েছিল জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলে যত তাড়াতাড়ি ভোট করানো যায় রাজ্যে। দ্রুত বোঝা যায়, হাওয়া উঠছে না। তার পর ৮ নভেম্বর নোট বাতিল হল। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা ভরসা রাখলেন, কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করে ভোটের বাজারে জোয়ার আনবেন। এক মাসে সেই লড়াইয়ের ধাক্কায় জনজীবন বেসামাল। রাজনীতির হাওয়া পরিকল্পিত চিত্রনাট্য মেনে বইছে না বুঝতে পেরেই বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার এখন উত্তরপ্রদেশে যতটা সম্ভব রয়েসয়ে ভোটে যেতে চাইছে।

রাজ্যে গত বার ভোট হয়েছিল ২০১২-র ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ, মোট ৮ দফায়। গত কাল রাজ্য সরকার ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার দিন স্থির করেছে। একে হাতিয়ার করে বিজেপি এখন চাইছে রয়ে-সয়ে এপ্রিল-মে মাস জুড়ে অন্তত ছ’দফায় নির্বাচন করানো হোক। যাতে নোট বাতিলের জেরে আমজনতা যে দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন, সেই ক্ষত মুছতে হাতে অন্তত মাস চারেক সময় পাওয়া যায়।

ক্ষতটা কতটা গভীর, মালুম হল রাজ্যের রাজধানীতে পা দিতেই!

হজরতগঞ্জের মোড়। অটোর জন্য দাঁড়াতেই পায়ের উপরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন রাজেন্দ্র। ‘‘জুতোটা পালিশ করিয়ে নিন। সকাল থেকে বউনি হয়নি।’’ বেলা দেড়টাতেও বউনি হয়নি! বলে কী লোকটা! রাজেন্দ্র বললেন, ‘‘১০টা টাকা দিয়ে জুতো পালিশ পর্যন্ত করাতে চাইছে না লোকে।’’ বুঝলাম খুচরো টাকার এমন আকাল। পকেটে কিছু থাকলেও, ভবিষ্যতের কথা ভেবে লোকে তা বার করছে না। ‘‘দিন না পুরনো ৫০০ বা ১০০০-এর নোট, সামনের ছ’মাস পালিশ করে দেব,’’ শেষমেষ বলেন নাছোড় রাজেন্দ্র।

কী করে বোঝাই, এই দফায় লখনউয়ে আমি দু’ দিনের মেহমান!

লখনউ স্টেশনে ভিন্ রাজ্যের ট্রেন ধরতে সাধারণ শ্রেণির কামরার সামনে দাঁড়িয়ে ইদ্রিশ, মামুন, সুরজরা। এঁরা মেহমান নন। মুম্বই, পঞ্জাব বা দিল্লি-নয়ডার ঠিকা কাজ ছেড়ে রাজ্যে ফিরেছিলেন ১০০ দিনের কাজ বা আবাসন শিল্পের ভরসায়। কিন্তু নগদের অভাবে এখন কাজ বাড়ন্ত। পেটের টানে ফের তাঁরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে।

বড়া ইমামবাড়ার সামনে ভিক্ষুকদের গুলতানিও ম্রিয়মাণ। প্রণামীর ডালাতেই পয়সা বাড়ন্ত, ভিক্ষের ঝুলিতে দু’-পাঁচ টাকা আসবে কী ভাবে! আমিনাবাদের কাবাবের দোকান বলছে, কমেছে বিক্রি-বাট্টা। বিক্রির সূচক কবে ঊর্ধ্বমুখী হবে, জানেন না লখনউ চিকনের কারবারিরা। শহরে এটিএমের লাইন লাগামছাড়া। নো-ক্যাশের সাইনবোর্ড। শহর থেকে গোমতীনগর এক্সটেনশন হয়ে একটু গ্রামের দিকে এগোতে একই হাহাকার।

খাঁ-খাঁ করছে খেত। লখনউ থেকে কানপুর-গোটা রাস্তায় অধিকাংশ খেতে বীজ পড়েনি। ‘‘টাকা কোথায়?’’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ কিষণকুমার। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই আগু-পিছু না ভেবে হাতের নগদ জমা দিয়েছিলেন ব্যাঙ্কে। এখন কপাল চাপড়াচ্ছেন। বলছেন, ‘‘টাকা জমা দিয়ে কী ভুলই যে করেছি! এখন নিজের টাকাই তুলতে পারছি না। বীজ-সার কিনতে পারিনি। এর পরে বেশি ঠান্ডা পড়ে গেলে বীজ বুনেও লাভ হবে না।’’ কিষণ একা নন, ভরা রবি মরসুমে হরিদপুর গ্রামের বটতলায় নিষ্কর্মা ভিড়েও একই উদ্বেগ। ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে মহাজন। দাবি, আগের ধার মেটাও।

সবটাই মোদীর নোট বাতিলের সৌজন্যে। শহর-গ্রামের যুব সমাজ শুরুতে মোদীর সিদ্ধান্তের পক্ষে সুর চড়ালেও, সেই স্বর খাদে নামতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা বিজেপির অন্যতম ভোটব্যাঙ্ক। তাঁরাও যে ভুগছেন, তা বুঝতে পারছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা।

বিজেপি সভাপতি শাহ কাল এবিপি নিউজ চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানে স্বীকার করে নেন, এই সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী মহলে প্রভাব পড়েছে। মনোভাব পরিবর্তনে দলের কর্মী-সমর্থকদের পথে নেমে মানুষজনকে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্ব বোঝানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর তাঁদের হাতে কিছুটা সময় তুলে দিতেই রয়ে-সয়ে ভোট চায় বিজেপি।

কী বললেন নরেন্দ্র মোদী?

• আপনাদের জনধন অ্যাকাউন্টে যদি অন্য কেউ টাকা রেখে থাকেন, তা হলে তাঁদের সেই টাকা ফেরত দেবেন না। আপনারা এই প্রতিশ্রুতি দিলে যাঁরা বেআইনি ভাবে আপনাদের অ্যাকাউন্টে টাকা রেখেছেন, তাঁদের কী ভাবে জেলে ভরা যায়, সেটা দেখছি।

• ৭০ বছর ধরে নানা প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য মানুষকে বিভিন্ন লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। সব লাইন বন্ধ করার জন্য এই লাইনই (ব্যাঙ্কের বাইরে) শেষ লাইন।

• যাঁরা অসৎ, তাঁরা আজ গরিব মানুষদের বাড়ির বাইরে লাইন দিচ্ছেন। আর যাঁরা সৎ, তাঁরা লাইন দিচ্ছেন ব্যাঙ্কের বাইরে।

• এখন আপনার মোবাইলেই আপনার ব্যাঙ্ক। এই দেশে এখন ৪০ কোটি স্মার্টফোন। তাই অন্তত ৪০ কোটি মানুষকে এখন আর নগদ লেনদেন করতে হবে না।

• বিরোধীরা আমার কী করবেন? আমি তো এক জন ফকির! ... ঝোলাটুকু নিয়েই চলে যাব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetization vote
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE