Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

চূড়ান্ত হট্টগোল, মারদাঙ্গার পরে ই কে পালানীস্বামীর দখলেই তামিলনাড়ুর গদি

দ্রাবিড় দঙ্গলের সাক্ষী রইল তামিলনাড়ু বিধানসভা। স্পিকারের ধুতি-জামা ধরে টানাটানি, পোশাক ছেঁড়াছেঁড়ি, টেবিল-চেয়ার-মাইক্রোফোন ভাঙচুর, টেবিলে উঠে হট্টগোল, স্পিকারের চেয়ারে বসে পড়া, নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বিধায়কদের কুস্তি— কিছুই বাকি থাকল না।

বিধায়কদের তাণ্ডবে রণক্ষেত্র তামিলনাড়ু বিধানসভা। শনিবার। ছবি: পিটিআই।

বিধায়কদের তাণ্ডবে রণক্ষেত্র তামিলনাড়ু বিধানসভা। শনিবার। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩১
Share: Save:

দ্রাবিড় দঙ্গলের সাক্ষী রইল তামিলনাড়ু বিধানসভা।

স্পিকারের ধুতি-জামা ধরে টানাটানি, পোশাক ছেঁড়াছেঁড়ি, টেবিল-চেয়ার-মাইক্রোফোন ভাঙচুর, টেবিলে উঠে হট্টগোল, স্পিকারের চেয়ারে বসে পড়া, নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বিধায়কদের কুস্তি— কিছুই বাকি থাকল না।

নাটকের শেষটা অবশ্য যেমন ভাবা গিয়েছিল, তেমনই হয়েছে। আপাতত শশিকলার ‘প্রক্সি’ ই কে পালানীস্বামীর দখলেই থাকছে তামিলনাড়ুর গদি।

শনিবার সকাল থেকে চূড়ান্ত হট্টগোল, মারদাঙ্গার পরে তামিলনাড়ু বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটাভুটিতে পালানীস্বামীর ঝুলিতেই সিংহভাগ ভোট পড়েছে। জেলে যাওয়ার আগে গোল্ডেন বে রিসর্টে নিজের বিশ্বস্ত বিধায়কদের ‘বন্দি’ করে ফেলেছিলেন শশিকলা। সেই দলে খুব একটা চিড় ধরেনি। শশী শিবিরের ১২২ জন পালানীস্বামীর পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। ‘বিদ্রোহী’ পনীরসেলভমের ঝুলিতে গিয়েছে মাত্র ১১টি ভোট। কিন্তু ভোটাভুটি করাতে মার্শাল ডেকে বিধানসভা থেকে

বার করে দিতে হয়েছে মারমুখী ডিএমকে বিধায়কদের।

আরও পড়ুন:
বিজেপির ছক কাজে এল না তামিলনাড়ুতে

পালানী বনাম পনীর— এডিএমকে-র গৃহযুদ্ধের যথাসম্ভব রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে আজ তৈরি ছিল ডিএমকে। করুণানিধি-পুত্র স্ট্যালিন প্রথমে পনীরসেলভমের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দাবি তোলেন, হয় ভোটাভুটি পিছিয়ে দেওয়া হোক। না হলে গোপন ব্যালটে ভোট নেওয়া হোক। পনীরসেলভমের যুক্তি ছিল, ৪৮ ঘণ্টা আগে পর্যন্তও বিধায়কেরা রিসর্টে বন্দি ছিলেন। তাঁরা আগে নিজেদের বিধানসভা এলাকায় যান। জনতার মত নিয়ে ফিরে এসে ভোট দিন। একই দাবি ছিল ডিএমকে-রও।

কিন্তু স্পিকার পি ধনপাল মানতে চাননি। এর পরেই স্ট্যালিনের নেতৃত্বে হুলস্থুল শুরু করেন ডিএমকে বিধায়কেরা। বিধানসভার সচিবের টেবিলে উঠে পড়েন কেউ কেউ। অধিবেশন বেলা ১টা পর্যন্ত মুলতুবি করে দেন স্পিকার। কিন্তু খণ্ডযুদ্ধ থামেনি। ডিএমকে বিধায়কেরা এ বার স্পিকারকে টানাহেঁচড়া শুরু করেন। তাঁর জামা ছিঁড়ে যায়। মার্শালরা কোনও রকমে স্পিকারকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। এর পরেই দেখা যায়, স্পিকারের আসনে বসে পড়েছেন ডিএমকে বিধায়ক কু কা সেলভা। বি রঙ্গনাথন নামে আর এক বিধায়ককেও স্পিকারের চেয়ারে বসে উল্লাস করতে দেখা যায়। রঙ্গনাথন একটি খুন, দু’টি অপহরণ, তিনটি হামলায় অভিযুক্ত।

বেলা ১টায় অধিবেশন ফের শুরু হলে স্পিকার ছেঁড়া জামা দেখিয়ে প্রশ্ন তোলেন, ‘‘কোথায় গিয়ে এই অপমানের কথা বলব!’’ অভব্য আচরণের জন্য ডিএমকে বিধায়কদের বার করে দেওয়ার নির্দেশ দেন স্পিকার। শুরু হয় মার্শালদের সঙ্গে আর এক প্রস্ত হাতাহাতি। ফের মুলতুবি হয় অধিবেশন। শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিনদের বার করে দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। বোতামছেঁড়া জামার ছেঁড়া বুকপকেট দেখিয়ে স্ট্যালিন পরে বলেন, ‘‘দেখুন, মার্শালরা আমাদের জোর করে উৎখাত করেছে। ভিতরে যে গণ্ডগোল হয়েছে, তার পুরো দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। দুঃখপ্রকাশও করছি। কিন্তু স্পিকার নিজের জামা নিজেই ছিঁড়েছেন। গোপন ব্যালটের দাবি উনি মানেননি।’’

ডিএমকে বিধায়কদের বার করে দেওয়ার পরে কংগ্রেসের ৮ বিধায়কও ওয়াক-আউট করেন। বেরিয়ে যান আইইউএমএল-এর একমাত্র বিধায়কও। শুধু শশিকলা ও পনীরসেলভমের গোষ্ঠীর এডিএমকে বিধায়কদের নিয়েই ভোটাভুটি হয়। এক জন ভোটদানে বিরত থাকলেও পালানীস্বামীর জিততে অসুবিধে হওয়ার কথা ছিল না। হয়ওনি। পনীরের আশা ছিল, হাতে সময় পেলে আরও বিধায়ক জোগাড় করতে পারবেন তিনি। তাই আস্থা ভোট পিছোতে চেয়েছিলেন। দিনের শেষে তিনি বলেন, ‘‘এই আস্থা ভোট কতটা বৈধ, তা মানুষ ঠিক করবে। লড়াই সবে শুরু। রাজ্যে আম্মার সুশাসনই প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ব।’’

হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্ট্যালিনও। বলেছেন, ‘‘এ হল গণতন্ত্রের কালো দিন। অপেক্ষা করুন, এখনও অনেক কিছু বাকি।’’ বিধানসভা থেকে বেরিয়ে রাজ্যপালের কাছে দরবার করেন করুণানিধি-পুত্র। তার পর মেরিনা সৈকতে ধর্নায় বসেন। সেখান থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করে প্রশাসন। পরে অবশ্য ছেড়েও দেয়। তত ক্ষণে বিধানসভার ঘটনার জেরে বিক্ষিপ্ত অশান্তি হয়েছে রাজ্যে।

প্রশ্ন উঠেছে, ভোটে না গিয়ে স্ট্যালিন কেন সরকার পক্ষকে ফাঁকা ময়দান ছেড়ে দিলেন? জবাবে অনেকে বলছেন, ডিএমকের ৮৮ জন বিধায়ক (অসুস্থ ও অনুপস্থিত করুণানিধিকে বাদ দিয়ে) পনীর শিবিরের ১১ জনের সঙ্গে মিলে বিপক্ষে ভোট দিলেও পালানীস্বামীর জয় আটকাত না। কংগ্রেস আগেই বলেছিল, তারা ভোটদানে বিরত থাকবে। ফলে একশোও পেরোতেন না বিরোধীরা। উল্টে এডিএমকে-র একাংশের পাশে হঠাৎ দাঁড়া়লে ডিএমকে নেতাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারত। বরং মার্শালরা তাঁদের বার করে দেওয়ায় স্ট্যালিন এখন বলতে পারবেন, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে আস্থা ভোটে। শশিকলাদের বিরুদ্ধে পনীর শিবির গোড়া থেকে যে অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলছিল, তাকেই এখন ‘হাইজ্যাক’ করে রাজ্য রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে পারে ডিএমকে।

শশী-পনীর দ্বৈরথ শুরু ইস্তক ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন স্ট্যালিন। তিনি ভেবেছিলেন, এডিএমকে শিবিরে যত বেশি দিন অস্থিরতা থাকবে, শাসক দলের উপরে মানুষের ক্ষোভও তত বাড়বে। এমনকী ভবিষ্যতে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলেও স্ট্যালিন বলতে পারবেন, জয়ললিতা-উত্তর যুগে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই। তখন নিজেকে দ্রাবি়ড় নেতা হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন তিনি।

ফলে নাটকে যবনিকা পড়েছে বলে মনে করছেন না কেউ। শশিকলা শিবিরও বুঝিয়ে দিয়েছে, এখনই ‘আম্মা আবেগ’-এর অস্ত্র হাতছাড়া করতে নারাজ তারা। আজ তাই ভোটের পরে পালানীস্বামীকে জয়ার সমাধিতে গিয়ে চোখের জলে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা গিয়েছে। জেলে যাওয়ার আগে যা করেছিলেন শশিকলা।

জামা খোলা স্ট্যালিন। বিধানসভার বাইরে ডিএমকে নেতা দেখাচ্ছেন, কী ভাবে ছেঁড়া হয়েছে তাঁর জামা। শনিবার। ছবি: পিটিআই।

যে অঙ্কে কুর্সি

• মোট আসন ২৩৫

• ম্যাজিক সংখ্যা ১১৭

এডিএমকে মোট বিধায়ক ১৩৬

১ জন মৃত (জয়ললিতা)

১ জন স্পিকার

১ জন ভোট দেননি

বাকি ১৩৩

• পালানীর পক্ষে ভোট ১২২

• পনীরের পক্ষে ১১

বিরোধীরা তখন ছিলেন না

হট্টগোলের ভোট

• ১১টা: বিধানসভা অধিবেশন শুরু।

• ১১.০৩: গোলমাল শুরু।

• ১১.০৬: মুখ্যমন্ত্রী পালানীস্বামীর আস্থা ভোটের প্রস্তাব পেশ।

• ১১.১৭: বিচ্ছিন্ন করা হল সচিবালয়ের প্রেস-রুমের অডিও সংযোগ।

• ১১.৩৩: অন্য দিন আস্থা ভোট করার দাবি স্ট্যালিনের।

• ১১.৩৪: স্ট্যালিনের দাবি খারিজ করলেন স্পিকার।

• ১২.০৫: স্পিকার ঘেরাও। গোপন ব্যালটের দাবি।

• ১২.২৬: দাবি খারিজ। শুরু ভাঙচুর।

• ১২.৪৪: বিরোধী নেতা স্ট্যালিনকে আলোচনায় ডাক স্পিকারের।

• ১.০০: আবার বসল অধিবেশন। বিশৃঙ্খলা জারি।

• ১.১৮: ডিএমকে বিধায়কদের বের করে দিতে নির্দেশ স্পিকারের।

• ১.৩০: বেলা তিনটে পর্যন্ত মুলতুবি অধিবেশন।

• ২.৪০: দলের অন্য বিধায়কদের সঙ্গে বার করে দেওয়া হল স্ট্যালিনকেও।

• ২.৫৯: রাজভবনের পথে রওনা স্ট্যালিন।

• ৩.১১: কংগ্রেস ও আইইউএমএল বিধায়কদের ওয়াকআউট।

• ৩.২৩: বিরোধী ছাড়াই আস্থা ভোট। পালানীস্বামীকে জয়ী ঘোষণা স্পিকারের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tamil Nadu Assembly Chaos Tamil Nadu War zone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE