Advertisement
১১ মে ২০২৪
উল্টো পথের পথিক

সংস্কারের সাহস না দেখে হতাশ সব পক্ষ

রানওয়েতেই দাঁড়িয়ে রইল নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলির বিমান। অর্থনীতির উড়ানের জন্য দরকার ছিল সাহসী ‘টেক-অফ’। অরুণ জেটলির আজকের বাজেটে সেই সাহসী সংস্কারেরই দেখা মিলল না। বরং এত দিন আউড়ে আসা অর্থনৈতিক দর্শন ভুলে ইউপিএ জমানার উল্টো রথেই সওয়ার হল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কারওরই মন পাননি অর্থমন্ত্রী। তাঁর ভীরু বাজেট না খুশি করেছে শিল্পমহলকে, না মধ্যবিত্তকে। বরং হতাশা ছড়িয়েছে সর্বত্র।

বাজেট পেশ করতে সংসদে ঢুকছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। শনিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ।

বাজেট পেশ করতে সংসদে ঢুকছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। শনিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩০
Share: Save:

রানওয়েতেই দাঁড়িয়ে রইল নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলির বিমান। অর্থনীতির উড়ানের জন্য দরকার ছিল সাহসী ‘টেক-অফ’। অরুণ জেটলির আজকের বাজেটে সেই সাহসী সংস্কারেরই দেখা মিলল না। বরং এত দিন আউড়ে আসা অর্থনৈতিক দর্শন ভুলে ইউপিএ জমানার উল্টো রথেই সওয়ার হল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।

কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কারওরই মন পাননি অর্থমন্ত্রী। তাঁর ভীরু বাজেট না খুশি করেছে শিল্পমহলকে, না মধ্যবিত্তকে। বরং হতাশা ছড়িয়েছে সর্বত্র। আয়করে মধ্যবিত্তকে সুরাহা দেননি জেটলি। কর্পোরেট সংস্থাগুলির করের হার ৩০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেছেন বটে, কিন্তু সেটা ঘটবে দীর্ঘ চার বছর ধরে। এবং তার পাশাপাশি নানা রকম ছাড় তুলে নেওয়ার কথাও বলেছেন। এর ফলে আখেরে শিল্পসংস্থাগুলির উপরে করের বোঝা যে বিশেষ কমবে, তা নয়।

শিল্পমহলের উষ্মার আরও একটা কারণ, এক কোটি টাকার বেশি আয়ের ব্যক্তিদের আয়করের উপর ২ শতাংশ হারে সারচার্জ বসানো। বাজেটে কর আদায়ের নতুন কোনও রাস্তা দেখাননি জেটলি। বাড়তি যা আয় করবেন আশা করেছেন, তার অধিকাংশটাই আসবে এই পথে। শিল্পমহলের মতে, কোনও রকম উদ্ভাবনী শক্তি দেখাতে ব্যর্থ জেটলির বাজেট দিনের শেষে হিসেব-নিকেশের খাতা হয়েই থেকে গিয়েছে।

বাজেট বক্তৃতার শুরুতে জেটলি নিজেই বলেছিলেন, “গোটা বিশ্ব ভবিষ্যদ্বাণী করছে, এ বার ভারতের সামনে ওড়ার সুযোগ।” রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, দুই মঞ্চই তৈরি ছিল। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা। নতুন শিল্প, কর্মসংস্থান তৈরির জন্যই মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম তাঁকে ভোট দিয়েছিল। অন্য দিকে অশোধিত তেলের দামে কমতি, নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসা মূল্যবৃদ্ধি, আমদানির খরচ কমে গিয়ে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ফুলেফেঁপে ওঠা, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদের হার কমাতে শুরু করার মতো অনুকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি ছিল।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

এই মুহূর্তে অর্থনীতিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার ছিল বেসরকারি লগ্নির ‘ইঞ্জিন’। বেসরকারি লগ্নি টেনে আনার জন্য বাজেটে নতুন লগ্নিতে যথেষ্ট পরিমাণে কর ছাড়ের মতো উৎসাহবর্ধক দাওয়াই ঘোষণা করতে পারতেন জেটলি। বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আছে, এই সুযোগে রাজকোষ ঘাটতি বেশি রেখেছেন তিনি। কিন্তু সেই বাবদ হাতে থাকা টাকাটা শিল্পে কর ছাড় বা উৎসাহ ভাতা খাতে খরচ করেননি তিনি। এই পথে হাঁটলে আখেরে অর্থনীতিরই লাভ হতো। কারণ নতুন শিল্পে বিনিয়োগ এবং উৎপাদনের টানে বৃদ্ধির হার বাড়ত। জেটলির সামনে সেই সুযোগ থাকলেও তিনি তা হারালেন। তিনি টাকা ঢাললেন সামাজিক প্রকল্প খাতে। যেখান থেকে অর্থনীতির স্থায়ী উন্নতির সম্ভাবনা নেই।

নরেন্দ্র মোদী সরকারের এটাই প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট। গত বছর মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর জুলাই মাসে তড়িঘড়ি বাজেট পেশ করেছিলেন জেটলি। সে বার তিনি ততটা সাহসী হতে পারেননি। সে দিক থেকে এ বারই মোদী-জেটলির সামনে আর্থিক সংস্কারের স্পষ্ট দিশানির্দেশ দেওয়ার সেরা সুযোগ ছিল। রাজনীতিকরা মনে করছেন, যে কোনও সরকারের সামনেই প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটেই সাহসী হওয়ার সেরা রাজনৈতিক সুযোগ থাকে। ভর্তুকি তুলে দেওয়ার মতো সাহসী পদক্ষেপ করতে হলে প্রথমেই করতে হয়। যত সময় যায়, ততই নানা রকম রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা পিছু টেনে ধরে। মোদী সরকারের ক্ষেত্রেও সে কথা সত্যি। আগামী বছর এপ্রিলে চারটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাড়ু ও অসম। এই চারটি রাজ্যেই ভাল ফল করার জন্য মরিয়া হয়ে ঝাঁপাবে বিজেপি। তার ঠিক আগে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির বাজেটে অর্থনীতির তেতো দাওয়াই প্রয়োগ করা কার্যত অসম্ভব।

মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিল্পমহলে সাময়িক উদ্দীপনা দেখা গেলেও নতুন লগ্নি অধরাই ছিল। নতুন কারখানা তৈরিতে শিল্পমহলের অনীহা ক্রমশ মোদী-জেটলির দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছিল। এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি লগ্নির জন্য ‘লাল কার্পেট’ পেতে দিতে পারতেন জেটলি। তা তিনি করতে পারেননি। তার বদলে তিনি সরকারের হাতে আরও টাকা রেখেছেন। সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে আর্থিক বৃদ্ধির উপরে ভরসা রেখেছেন। পরিকাঠামোয় খরচ করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার হাতে টাকা তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন। এটা ঠিক যে পরিকাঠামো খাতে প্রত্যাশিত বেসরকারি লগ্নি আসছে না। কিন্তু তথ্য বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির হাতে এখনই দু’লক্ষ কোটি টাকারও বেশি নগদ মজুত রয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। আরও বেশি টাকা হাতে এলে তারা কী ভাবে খরচ করবে, সেই প্রশ্নও উঠেছে। অনেকে মনে করছিলেন, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের মতো সদর্থক নীতির

দেখা মিলবে বাজেটে। ঠিক যে ভাবে বাজপেয়ী জমানায় অরুণ শৌরিকে মন্ত্রী করে আলাদা বিলগ্নিকরণ মন্ত্রক তৈরি হয়েছিল। বেসরকারিকরণের কথা জেটলি বলেছেন ঠিকই। কিন্তু তা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বেচে টাকা তুলতে। বেসরকারিকরণের পথে হাঁটতে নীতিগত ভাবে পারেননি।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেছেন, “জেটলির ভাগ্য তাঁর প্রতি সদয় ছিল। অশোধিত তেলের দাম কমে যাওয়ার মূল্যবৃদ্ধি কমে এসেছিল। আমি আশা করেছিলাম, এই অনুকূল সময়টাকে তিনি অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে একটা বড় মাপের কার্যকরী নিখাদ ধাক্কা দেবেন। কিন্তু তা হয়নি।” বাজেটে যে নতুন করের রাস্তা তৈরি হয়নি, তিনি তার দিকেও আঙুল তুলেছেন। জেটলি জানান, অতি-ধনীদের আয়করের উপর সারচার্জ বসিয়ে যে আয় হবে, তার পুরোটাই কেন্দ্রের রাজকোষে থাকবে। রাজ্যগুলির সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে না।

জেটলির ব্যাখ্যা, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে রাজ্যগুলির হাতে নিজস্ব আয়ের প্রায় ৬২ শতাংশ তুলে দিতে হচ্ছে। তাই এমনিতেই তাঁর হাতে অর্থ কমে এসেছিল। তা-ও তিনি রাজকোষ ঘাটতি লাগামছাড়া হতে দেননি। চলতি বছরেও ৪.১ শতাংশের রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে চলেছেন। তবে নতুন অর্থবর্ষে আর্থিক শৃঙ্খলা কিছুটা শিথিল করে হাতে বেশি টাকা রাখার সুযোগ তৈরি করেছেন। যাতে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকারি ব্যয় বাড়ানো যায়। আর্থিক শৃঙ্খলা আইন অনুযায়ী আগামী দু’বছরে রাজকোষ ঘাটতি ৩ শতাংশে কমিয়ে আনার কথা। জেটলি দু’বছরের বদলে তিন বছরে সেই ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রা ছোঁবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেটলি হয়তো শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন যে, চলতি বছরে ঘাটতি বাড়লে আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলি বিরূপ মনোভাব নিতে পারে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শিল্পমহলকে কর ছাড় বা উৎসাহ ভাতা দিতে গিয়ে কেন্দ্রের আয়-ব্যয়ের ফারাক বা রাজকোষ ঘাটতি বাড়লেও ক্ষতি ছিল না। রেটিং এজেন্সিগুলি যদি বুঝত মোদী সরকার আর্থিক সংস্কারের পথে বদ্ধপরিকর, তা হলে ঘাটতি বাড়লেও তারা ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিত না।

রাজনীতিকরা মনে করাচ্ছেন, বাজেট প্রস্তুতিপর্বে অধিকাংশ কেন্দ্রের অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা যুক্তি দেন, কেন্দ্র রাজকোষ ঘাটতির কথা ভুলে গিয়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কথা ভাবুক। রাজ্যগুলিকেও রাজকোষ ঘাটতি শিথিলের সুযোগ দেওয়া হোক। তাই রাজকোষ ঘাটতি বাড়ালে রাজ্যগুলিরও সমর্থন পেতেন জেটলি। কিন্তু তিনি সেই ছক ভাঙার সাহস দেখাতে পারেননি। নতুন ট্রেন ঘোষণা না-করে রেল বাজেটে যে সাহস দেখিয়েছিলেন সুরেশ প্রভু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

central budget 2015 premangshu chowdhury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE