আরোগ্যের আশায়: সন্তানের বিছানায় উদ্বিগ্ন মা। বিআরডি হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র।
বছর বারোর বিসা ক’দিন আগে বাবাকে বলেছিল, এ বার একটা বড় তেরঙ্গা পতাকা কিনে দিতেই হবে। স্বাধীনতা দিবসে ওই পতাকা স্কুলে নিয়ে যাবে সে।
রবিবার থেকে গায়ে ধুম জ্বর নিয়ে গোরক্ষপুরের বিআরডি হাসপাতালের এনসেফ্যালাইটিস ওয়ার্ডে ভর্তি বিসা। নাকে অক্সিজেনের নল। মেঝেয় মাথায় হাত দিয়ে বসে বাবা ওমপ্রকাশ।
একই বিছানায় সাড়ে তিন বছরের প্রিয়াংশু। নাকে অক্সিজেনের নল। মাথাটা ফুলে উঠেছে। সামনে বসা মায়ের চোখের জল বাঁধ মানছে না। ওয়ার্ডের বাইরে কাচে মুখ ঠেকিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে বাবা অখিলেশ।
অখিলেশ-ওমপ্রকাশ দুজনেই জানেন, এই হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে ৬০টিরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ৩০টিরও বেশি শিশু মারা গিয়েছে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, অক্সিজেনের অভাবে। কিন্তু উপায় কী! বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার সাধ্যি নেই। গোরক্ষপুর লাগোয়া বিস্তীর্ণ এলাকায় এনসেফ্যালাইটিস কার্যত মহামারীর চেহারা নিয়েছে। এখানকার লক্ষ লক্ষ মানুষের ‘ভরসা’ বলতে এই একটিই সরকারি হাসপাতাল।
হাসপাতালে ঢুকলে অবশ্য ভরসা কম, ভয় বেশি হয়! সংক্রমণ ঠেকাতে মুখে মেডিক্যাল মাস্ক বাধ্যতামূলক। তা সত্ত্বেও দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। করিডরের মেঝেয় খবরের কাগজ পেতে সন্তানকে শুইয়ে বাবা-মা ভর্তির জন্য দৌড়োদৌড়ি করছেন। তার পাশ দিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে কুকুর-গরু-বাছুর। বৃষ্টির জমা জলে আবর্জনা, গোবর মিলেমিশে এক। এই হাসপাতালে রোগ সারাবে কে! এক ডাক্তারের কথায়, “এখন তো অনেক ভাল দেখছেন। শিশুমৃত্যু নিয়ে হইচই, মুখ্যমন্ত্রী আসায় অনেকটা সাফসুতরো হয়েছে।”
আরও পড়ুন:মোদীকে বিঁধে যোগীই ভরসা গোরক্ষপুরের
স্বাধীনতার ৭০ বছরে দেশের সিংহ ভাগ সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরিষেবার ছবিটা কেমন, তার আদর্শ নমুনা হতে পারে গোরক্ষপুরের এই হাসপাতাল। এক দিকে চূড়ান্ত অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, অন্য দিকে দুর্নীতি। হাসপাতালের করিডরে ঘুরতে ঘুরতেই শোনা যায়, এত দিন হাসপাতালের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন সদ্য বরখাস্ত হওয়া সুপার রাজীব মিশ্রর স্ত্রী পূর্ণিমা শুক্ল। অথচ তিনি কোন পদে ছিলেন, কারও জানা নেই।
চিকিৎসক-নার্সদের বক্তব্য, পাইপের অক্সিজেন বন্ধ হলেও পরিস্থিতি সামলাতে স্টোররুমে ৩০০ থেকে ৪০০ সিলিন্ডার মজুত থাকত। পুষ্পা সেলসের সঙ্গে অন্য একটি সংস্থাও সিলিন্ডার সরবরাহ করত। গত মার্চে তাদের বরাত বাতিল করা হয়। সব চাপ পড়ে পুষ্পা সেলসের কাঁধে। সেখানেও নাকি ‘কমিশন’-এর বাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদ চলছিল। সিলিন্ডারের জোগান কমে যাওয়ায় স্টোররুমে মজুত সিলিন্ডারের সংখ্যা ৫০-৬০-এ নেমে আসে। এই অক্সিজেনের অভাবেই গত ১০ ও ১১ অগস্ট ৩০টি শিশুর মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ। পরের তিন দিনে এনসেফ্যালাইটিসে আরও ছ’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে।
গোটা হাসপাতালের যা অবস্থা, তা সামাল দেওয়া যে কঠিন, তা মানছেন এখানকার ডাক্তার-নার্সরাও। কিন্তু কী করলে পরিস্থিতি শুধরোবে, তা-ও বুঝতে পাছেন না। আর যার ফল— বিসা, প্রিয়াংশুদের জীবন সুতোয় ঝুলে থাকা। সেটাই উদ্বেগের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy