Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

রোহতকে কপ্টারে সেনা, জারি তাণ্ডব

হরিয়ানার বিজেপি সরকারের যাবতীয় আশ্বাসকে খড়কুটোর মতো উ়ড়িয়ে দিয়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে জাঠ বিক্ষোভের আগুন। সংরক্ষণের দাবি নিয়ে এখনও পর্যন্ত সংঘর্ষের বলি ছয়টি প্রাণ।

রণক্ষেত্র। রোহতকের রাস্তায় চলছে বিক্ষোভ। শনিবার। — এএফপি

রণক্ষেত্র। রোহতকের রাস্তায় চলছে বিক্ষোভ। শনিবার। — এএফপি

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২১
Share: Save:

হরিয়ানার বিজেপি সরকারের যাবতীয় আশ্বাসকে খড়কুটোর মতো উ়ড়িয়ে দিয়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে জাঠ বিক্ষোভের আগুন। সংরক্ষণের দাবি নিয়ে এখনও পর্যন্ত সংঘর্ষের বলি ছয়টি প্রাণ।

পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠায় কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের তরফেই আজ আন্দোলনকারী জাঠেদের জানিয়ে দেওয়া হয়, শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে তাদের সংরক্ষণের দাবি বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এতে কাজ তো হয়ই নি, উল্টে হরিয়ানা পরিস্থিতি মোদী সরকারের সামনে বড়সড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী ও আমলারা আজ পরিস্থিতি সামলাতে আলোচনায় বসেছিলেন। সেনাপ্রধান ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

এক বছর আগেই দেশের শীর্ষ আদালত ফিরিয়ে দিয়েছিল হরিয়ানার জাঠ সম্প্রদায়ের সংরক্ষণের প্রস্তাব। সেই দাবি নিয়েই এখন নতুন ভাবে বিক্ষোভের পথে জাঠেরা। তবে প্রবল চাপের মধ্যে পড়ে দেশের এই বর্ধিষ্ণু কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমঝোতার পথেই যেতে চাইছে বিজেপি।

কয়েক দিন ধরেই হরিয়ানার বিভিন্ন শহরে জাঠেদের বিক্ষোভ চলছিল। গত কাল থেকে তা হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলিও চালায় পুলিশ। বিক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। গত কালই হরিয়ানার তিন শহর, রোহতক, ভিওয়ানি ও ঝজ্জরে কার্ফু জারি করেছিল পুলিশ। আজ কার্ফু জারি হয়েছে সোনীপত এবং গোহানাতেও। হরিয়ানার প্রায় সব শহরে সেনার ফ্ল্যাগ মার্চও হয়। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে ওঠে যে, রোহতকে পৌঁছতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয় সেনাবাহিনীকে।

ভাঙচুর, গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াই শুধু নয়, হরিয়ানার সব জাতীয় সড়কগুলি জায়গায় জায়গায় গাছ ফেলে বন্ধ করে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। সে জন্যই রোহতকে হেলিকপ্টারে পৌঁছতে হয়েছে সেনাকে। আন্দোলনকারীরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে জিন্দের রেল স্টেশনে। কাঁচামালের জোগান ব্যাহত হওয়ায় গুড়গাঁও ও মানেসারের কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করেছে মারুতি সুজুকি সংস্থা। আন্দোলনের আঁচ দিল্লি, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যা সরকারের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।

উদ্বেগ ও আশঙ্কার মধ্যে গত কাল রাত থেকেই রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি ও মনোহর পর্রীকররা নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেন। হরিয়ানার জাঠ নেতাদের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন দিল্লির বিজেপি নেতারা। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, আন্দোলন যে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে কোনও জাঠ নেতার হাতেই বিক্ষোভের লাগাম নেই। জাঠ পরিবারের তরুণ ছেলেমেয়েরাও বেপরোয়া ভাবে পথে নেমেছেন। ফলে প্রশাসনিক ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ারও চেষ্টা করেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। এ জন্য মোদী সামনে রেখেছেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী চৌধুরি বীরেন্দ্র সিংহকে। জাঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে। হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর অবশ্য দাবি করেছেন, জাঠেদের আবেগ বুঝতে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে না। কৌশলী মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, জাঠেদের সংরক্ষণ পাওয়া উচিত। কিন্তু সবার আগে দরকার রাজ্যে শান্তি ফেরানো। জাঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে খট্টর গত কাল বলেছিলেন, তাঁদের বিশেষ অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে সংরক্ষণ দেওয়া হবে। জাঠ নেতারা অবশ্য সেই ‘খেলনা’-য় ভুলতে চাননি। জাঠেদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে তা যে সাংবিধানিক ভাবে বৈধ হবে না, মোদী সরকারের কাছে তা পরিষ্কার। একই কারণে গুজরাতের পটেলদের সংরক্ষণ দেওয়া যায়নি। ২০১৪ সালে হরিয়ানায় বিধানসভা ভোটের আগে সেখানকার ভূপেন্দ্র হুডা সরকার রাজনৈতিক কারণে জাঠ সংরক্ষণে সায় দিয়েছিলেন। তার পর কেন্দ্রে মনমোহন সিংহ সরকার অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের আওতায় তাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করে দেয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে পাল্টা আবেদন পেশ হয়। তার পরেই শীর্ষ আদালত পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, জাতের ভিত্তিতে ‘ওবিসি’ কোটার আওতায় সংরক্ষণ দেওয়া যাবে না। কারণ, সামাজিক অনগ্রসরতাই এ ক্ষেত্রে সংরক্ষণ দেওয়ার একমাত্র মাপকাঠি।

আর জাঠেরা সামাজিক ভাবে অনগ্রসরও নন। হরিয়ানার ২৯% মানুষ জাঠ। তাঁদের কাছে বরাবর চাষের জমিজমা ছিল। আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে তাঁরা পিছিয়ে ছিলেন না। তাই নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে সংরক্ষণের দাবিতে জাঠেরা বারবার আন্দোলনে নামলেও তা কখনও সদর্থক পরিণতি পায়নি। এমনকী ১৯৯৭ সালে তাঁদের আন্দোলনের পরে অনগ্রসর জাতি কমিশনও জাঠেদের সংরক্ষণের প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, প্রবল বিদ্রোহের মুখে সাংবিধানিক যুক্তি খড়কুটোর মতোই। তাই কিছু আশ্বাস দিয়ে আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছেন তাঁরা। বিজেপির কিছু নেতা অবশ্য পরিস্থিতি জটিল হওয়ার জন্য দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ‘নির্বুদ্ধিতা’-কেই দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, হরিয়ানায় জাঠেরাই প্রভাবশালী সম্প্রদায়। সেখানে এক জন অ-জাঠ নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী করে মোদী-অমিত শাহরা ভুল করেছেন।

তবে অন্তত দু’টি বিষয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিছুটা হলেও স্বস্তিতে। প্রথমত, হরিয়ানার পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া কংগ্রেসের পক্ষেও সম্ভব নয়। জাঠেদের সমর্থন না করে হিংসা থামানোর জন্য রাহুল গাঁধী, ভূপেন্দ্র সিংহ হুডারা আজ বারবার আবেদন জানিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, হরিয়ানা বিতর্কের কারণে জেএনইউ বিতর্ক সাময়িক ভাবে পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে।

তবে বিজেপি বুঝেছে, আন্দোলনে হরিয়ানা অচল থাকলে তার প্রভাব একটি রাজ্যের চৌহদ্দিতে আটকে থাকবে না। ধাক্কা অন্য রাজ্যেও পড়বে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE