এড্স ভাইরাস।
তা হলে কি এ বার এড্সের রক্ত পরীক্ষাটা বাড়িতে বসেই করা যাবে? আর সেই পরীক্ষাটা কি আমি, আপনি করতে পারব নেহাতই হেসে-খেলে? আর আগের চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত ভাবে?
আমাদের ‘রক্তের লিখন’টা কি এ বার আমরা বাড়িতে বসেই পড়ে নিতে পারব কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইল, আইফোনে? আর সেটা কি সম্ভব হবে এখন সুদূর গ্রাম, গ্রামাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় বসেও?
তেমনটাই দাবি একেবারে হালের একটি গবেষণার। যা জানাচ্ছে কোনও দৌড়ঝাঁপ না করে বাড়িতে বসে এড্সের রক্ত পরীক্ষার সেই ফলাফলটা আমরা কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইলে পড়তে পেরে যাব আধ ঘণ্টার চেয়েও কম সময়ের মধ্যে! আর শুধুই এড্স ভাইরাস শরীরে বাসা বেঁধেছে কি না, সেটুকু জানাই নয়, রক্তস্রোতে তার পরিমাণ কতটা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিমাণ বাড়া-কমা করছে কি না, সাম্প্রতিক গবেষণার দাবি, এ বার সেটাও জেনে নেওয়া যাবে বাড়িতে বসেই!
এইচআইভি-র শরীরের অন্দরে...
‘নভেল পিএইচ সেন্সিং সেমিকন্ডাক্টর ফর পয়েন্ট-অফ-কেয়ার ডিটেকশন অফ এইচআইভি-ওয়ান ভাইরেমিয়া’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস্’-এ। তাতে যে নতুন প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে, তার মাধ্যমে আমাদের শরীরে রক্তস্রোতের মধ্যে কতটা এড্স ভাইরাস- ‘এইচআইভি-ওয়ান’ রয়েছে, তা মাপা যাবে। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীরা একটি নামজাদা সংস্থা ‘ডিএনএ ইলেকট্রনিক্স’-এর সহযোগিতায় বাড়িতে বসে নিখুঁত ভাবে এড্সের রক্ত পরীক্ষার একটি যন্ত্রও বানিয়ে ফেলেছেন। যা আদতে একটি ‘ইউনিভার্সাল সিরিয়াল বাস’ বা ইউএসবি ড্রাইভ। যার কাজ মূলত মোবাইল ফোন থেকে কম্পিউটার, ল্যাপটপে বা ঠিক তার উল্টো পথে ডেটা বা তথ্যের আদানপ্রদান করা।
ইউএসবি ড্রাইভেই এড্সের রেজান্ট!
এর সুফলটা কোথায়?
সহযোগী গবেষক আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অনাবাসী ভারতীয় অমিত দামানির কথায়, ‘‘সেটা বুঝতে গেলে জানতে হবে, এড্সের রক্ত পরীক্ষাটা এখন কী ভাবে করা হয় আর তা করতে ন্যূনতম কতটা সময় লাগে? এখন সবচেয়ে প্রচলিত যে পদ্ধতিতে এড্সের রক্ত পরীক্ষা করা হয়, তার ফলাফলটা জানতে গেলে, খুব কম করে হলেও, সময় লাগে তিন দিন বা ৭২ ঘণ্টা। বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারও বেশি। আর সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য রোগীর রক্তের নমুনাটা পাঠাতেই হয় ল্যাবরেটরিতে। কারণ, এখন এড্সের রক্ত পরীক্ষাটা বাড়িতে বসে করা যায় না। আবার যে কোনও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে এড্সের রক্ত পরীক্ষাটাও করা যায় না। আরও সমস্যা রয়েছে। বিশ্বে এখন যে সব দেশে এড্সে আক্রান্তের সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি, তার অনেকগুলিতেই এড্সের রক্ত পরীক্ষার সর্বাধুনিক ব্যবস্থাটা পর্যন্ত নেই। ফলে, বেশির ভাগ ল্যাবরেটরিতেই এড্সের রক্ত পরীক্ষাটা করা যায় না। আর অনেক ক্ষেত্রেই তা নির্ভুলও হয় না। আর প্রচলিত পদ্ধতিতে হেসে-খেলে রক্তস্রোতে এড্স ভাইরাসের মাত্রা মাপার কাজটা সত্যি-সত্যিই বেশ দুরূহ। তা অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে বলে।’’
এইচআইভি-র শরীরের অন্দরে...
এড্সের চিকিৎসার ক্ষেত্রে চালু পদ্ধতিটির নাম- ‘অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ট্রিটমেন্ট’। যা কোনও কোনও ক্ষেত্রে (খুবই কম) আমাদের শরীরের রক্তে এড্স ভাইরাসের বাসা বাঁধার মাত্রাটাকে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। নানা রকমের ওষুধের ব্যবহারে। কিন্তু যেটা আকছারই ঘটে থাকে, তা হল, চালু পদ্ধতির ব্যর্থতা। মানে, যখন ওষুধ দিয়ে শরীরের রক্তস্রোতে এড্স ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতি রোখা যায় না। যাকে বলা হয়, ‘ওষুধ কাজ করছে না’। কেন ওষুধ কাজ করে না ওই সময়? কারণ, শরীরে ওই ওষুধটির সঙ্গে যুঝতে যুঝতে হানাদার এড্স ভাইরাস তখন তাকে রোখার কায়দা-কসরৎটা শিখে ফেলেছে বা আয়ত্ব করে নিয়েছে। আর সেটা যদি করে ফেলে, তা হলে ব্যবহৃত ওষুধকে আর পাত্তা না দিয়ে আক্রান্তের শরীরে আবার দাপাদাপিটা ‘এইচআইভি-ওয়ান’ শুরু করে দেয় নতুন উদ্যমে। এই যে বাড়তি উদ্যমে শরীরে আবার দাপাদাপিটা শুরু করে দিয়েছে এড্স ভাইরাস, সদ্য আবিষ্কৃত যন্ত্র ও প্রযুক্তিতে তা বাড়িতে বসেই মাপা যাবে ওই ইউএসবি ড্রাইভ দিয়ে, হেসে-খেলে। আর তা বাড়িতে বসেই করা যাবে বলে রক্তস্রোতে ভাইরাসের মাত্রাটা খুব ঘন ঘন মেপে বা জেনে নেওয়াটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে।
শরীরে এড্স ছড়ানোর পর...
মূল গবেষক লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর গ্রাহাম কুক ই-মেলে পাঠানো জবাবে আনন্দবাজারকে লিখেছেন, ‘‘চালু পদ্ধতিতে যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়, তার আকার অনেকটা ঢাউস চেহারার জেরক্স বা ফোটোকপিয়ার মেশিনের মতো। শুধু যান্ত্রিক জটিলতাই নয়, চালু পদ্ধতিটি ব্যয়সাপেক্ষও। সময় লাগে অনেক বেশি। আর পুরোপুরি নির্ভুলও নয়। আর আমরা এখন যে যন্ত্রটি বানিয়েছি রক্তে এড্স ভাইরাসের মাত্রা মাপার জন্য, তা আদতে একটা ইউএসবি ড্রাইভ। চেহারার ফারাকটা এখানেই মালুম হবে। এর ফলে, এক দিন আমরা বাড়িতে বসেই ব্লাড প্রেসার, সুগার মাপার মতো রক্তে এড্স ভাইরাসের মাত্রাটাও জেনে নিতে পারব, আধ ঘণ্টারও কম সময়ে। প্রত্যন্ত, দুর্গম এলাকার রোগীরাও এতে দারুণ ভাবে উপকৃত হবেন।’’
এড্স ভাইরাস, অণুবীক্ষণের নীচে
কী ভাবে কাজ করবে এই ইউএসবি ড্রাইভটি?
সহযোগী গবেষক অমিত দামানি বলছেন, ‘‘ইউএসবি ড্রাইভের স্টিকের ওপর একটা জায়গা চিহ্নিত করা থাকবে। খুব সামান্য মাত্রায় তার ওপর আক্রান্তের রক্ত ফেলতে হবে। রক্তে এড্স ভাইরাস থাকলে বা তার মাত্রা বেড়ে গেলে ওই যন্ত্রটির স্টিকে লাগানো অ্যাসিডের রং বদলে দেবে, বদলে দেবে সেই অ্যাসিডের কিছু গুণাগুণও। ওই রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে যে রাসায়নিক শক্তি উৎপন্ন হবে, শক্তির রূপান্তরের স্বাভাবিক নিয়মে তার কিছুটা বদলে যাবে বিদ্যুৎ শক্তিতে। তার ফলে ইলেকট্রিক সিগন্যাল বা বিদ্যুৎ সংকেতের সৃষ্টি হবে। অনেকটা ‘ইলেকট্রিক্যাল স্পার্ক’-এর মতো। ইউএসবি ড্রাইভের স্টিকের মাধ্যমে সেই ‘ইলেকট্রিক্যাল স্পার্ক’-ই কম্পিউটার, ল্যাপটপের স্ক্রিনে রক্ত পরীক্ষার ফলাফলটাকে ফুটিয়ে তুলবে। আমরা রক্তের ৯৯১টি নমুনা পরীক্ষা করে দেখেছি। আমাদের অ্যাকিউরেসির মাত্রা ছিল ৯৫ শতাংশ। আর ফলাফল জানতে পারার গ়়ড় সময় ছিল ২০.৮ সেকেন্ড। একই ভাবে হেপাটাইটিস ভাইরাসের মাত্রাও জানা-বোঝা যায় কি না, আমরা এখন সেই পরীক্ষাটাই করে চলেছি।’’
আরও পড়ুন- ক্যান্সারের নতুন সাত বাহকের হদিশ মিলল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy