Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Science

পৃথিবীতে এত বড়, এত ভারী, এত উজ্জ্বল হিরে এল কোথা থেকে?

এত বড় আর এত উজ্জ্বল হিরে এর আগে আমাদের নজরে আসেনি এই বাসযোগ্য গ্রহে! এত দিন পর এ বার সেই ‘অধরা’ গভীরতাকে মাপতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। জানতে পারলেন, ধরিত্রীর ‘হৃদয়’ আক্ষরিক অর্থেই, কতটা গভীর! আর সেই ‘আন্তরিকতা’ কতটা নিখাদ হীরক-ভাণ্ডারে!

সুূজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ ১০:৩৭
Share: Save:


এত বড় আর এত উজ্জ্বল হিরে এর আগে আমাদের নজরে আসেনি এই বাসযোগ্য গ্রহে!

এত ভারী, এত উজ্জ্বল হিরে কোথা থেকে এল পৃথিবীতে? কোন অতলে সে তলিয়ে ছিল কোটি কোটি বছর আগে? এই পৃথিবীর কতটা অতলান্ত অন্দরে-অন্তরে আঁতুড়ঘর সেই হিরের? সেই অতলান্ত গভীরে কী ভাবেই-বা জন্ম হয়েছিল এই সব সুবিশাল, ভারী ভারী আর অসম্ভব রকমের উজ্জ্বল হিরের? কারা সেই সব হিরের ‘শরীর’ গড়ে দিয়েছিল আর কী ভাবেই-বা সেই সুবিশাল আর উজ্জ্বলতম হিরে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের আদিগন্ত, অতলান্ত গভীর থেকে উঠে এসেছিল ভূপৃষ্ঠে, সেই ইতিহাস এখনও আমাদের অজানা, অচেনা, অধরাই থেকে গিয়েছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্মূল্য হিরে কোনগুলি? দেখুন ভিডিও।

এত দিন পর এ বার সেই ‘অধরা’ গভীরতাকে মাপতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। জানতে পারলেন, ধরিত্রীর ‘হৃদয়’ আক্ষরিক অর্থেই, কতটা গভীর! আর সেই ‘আন্তরিকতা’ কতটা নিখাদ হীরক-ভাণ্ডারে! জানা গেল, রাশি রাশি হিরে লুকিয়ে রয়েছে পৃথিবীর অন্তর-অন্দরের কতটা গভীরে। যতটা হিরে আমরা পেয়েছি চার পাশে, আগ্নেয়গিরির ‘দয়া ও দাক্ষিণ্যে’, তার চেয়ে আরও কত বেশি হিরে লুকিয়ে থাকতে পারে পৃথিবীর অতল গভীরে, তারও আন্দাজ করতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রথম। ‘জেমোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ আমেরিকা’ (জিআইএ)-র পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ভূতত্ত্ববিদ ইভান স্মিথের গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। যার সহযোগী গবেষক ওই মার্কিন ইনস্টিটিউটেরই ভূতত্ত্বের অনাবাসী ভারতীয় গবেষক পারুল থাপার। গবেষণাপত্রটি নিয়ে এখন তোলপাড় গোটা বিশ্ব।

আরও পড়ুন- বিশ্বের সবচেয়ে বড় দশটি হিরে


দুর্মূল্য, দুর্লভ ‘কালিনান ডায়মন্ড’



‘লেসোথো প্রমিস ডায়মন্ড’

চল গভীরে যাই...

কতটা গভীরে আমরা যেতে পারি, যেতে পেরেছি পৃথিবীর? আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের অন্তর-অন্দর বলতে ঠিক কী বোঝায়, কতটা গভীর ধরিত্রীর ‘আন্তরিকতা’, তার ঠাওর পাইনি আমরা এখনও। এত কোটি, লক্ষ, হাজার হাজার বছর পরেও! সেই ‘অচেনার অন্ধকারে’ এ বার ‘আলো’ পড়ল।

ধরিত্রীর ওই অধরা গভীরতা সম্পর্কে কী জানা গিয়েছে হালের গবেষণায়?


মূল গবেষক ইভান স্মিথ (বাঁ দিকে) ও সহযোগী ভারতীয় গবেষক পারুল থাপার

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে মহারাষ্ট্রের কন্যা পারুল থাপার নিউইয়র্ক থেকে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘আমাদের গবেষণায় এই প্রথম জানা গেল, পৃথিবীর অন্তরে-অন্দরে যতটা গভীরে আমরা এই একুশ শতকে পা দিয়ে পৌঁছতে পেরেছি, কম করে তার ৫ থেকে সাড়ে ৫ গুণ বেশি গভীর এই ধরিত্রীর ‘আন্তরিকতা’। আর পৃথিবীর সেই গভীরতম অন্তরের অন্দরেই লাগাতার বয়ে চলেছে উষ্ণতম তরল ধাতুর (লিক্যুইড মেটাল) স্রোত। ‘হৃদয়ে’ কী ভীষণ রকমের ‘উষ্ণ’ ধরিত্রী, এখনও; এই প্রথম তার প্রমাণ পেলেন বিজ্ঞানীরা। জানা গেল, আমাদের পায়ের তলা (ভূপৃষ্ঠ) থেকে অন্তত ৫০০ মাইল নীচে উষ্ণতম তরল ধাতুর স্রোত থেকেই কোটি কোটি বছর আগে জন্ম হয়েছিল এই সব সুবিশাল, অসম্ভব রকমের ভারী আর উজ্জ্বলতম হিরের। যা আমাদের এত দিনের ধারণাকে নাড়া দিল সজোরে।’’

কেন? নতুন কী জানতে পারলাম আমরা?


দুর্মূল্য, দুর্লভ ‘কালিনান ডায়মন্ড’

পারুল বলছেন, ‘‘আমরা এত দিন জানতাম, চার পাশে যে সব হিরে দেখা যায়, সেগুলির ‘আঁতুড়ঘর’ আমাদের পায়ের তলা থেকে বড়জোর ১৫০ বা ২৫০ কিলোমিটার (বা, ১৫৫.৩ মাইল) নীচে। আমরা অনেক দিন ধরেই কাজ করছিলাম খুব বড় আর ভারী ও অসম্ভব রকমের উজ্জ্বল হীরক-খণ্ডগুলি নিয়ে। যার মধ্যে ছিল বিখ্যাত ‘কালিনান ডায়মন্ড’ আর ‘লেসোথো প্রমিস’-এর মতো দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ হিরেও। দাম, বিশালত্ব আর উজ্জ্বলতার নিরিখে এই হিরেগুলি ইংল্যান্ডের ‘ক্রাউন অফ জুয়েল্‌স’-এও ঠাঁই পেয়েছে। যেহেতু পৃথিবীর যাবতীয় দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্য হিরেকেই ‘গ্রেডেশন’ পাওয়ার জন্য আসতে হয় আমেরিকার জেমোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটে, তাই আমরা এই ধরনের হিরে নিয়ে গবেষণা চালানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাদের এত দিনের ধারণা ছিল, ভূপৃষ্ঠের নীচে, পৃথিবীর ‘ম্যান্টলে’র (‘কোর’-এর ঠিক ওপরের স্তর) প্রায় পুরোটাই ভর্তি পাথুরে পদার্থে। কিন্তু এই সব দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্য হিরেগুলি জানাল, বোঝাল, পৃথিবীর ‘ম্যান্টলে’ও রয়েছে প্রচুর ধাতু। যেগুলি প্রচণ্ড তাপমাত্রায় গনগনে ধাতুর স্রোত হয়ে বয়ে চলেছে লক্ষ-কোটি বছর ধরে। এটা আগে জানা যায়নি, কারণ, আমরা পৃথিবীর এতটা গভীরে এখনও পর্যন্ত খনন চালানো সম্ভব হয়নি, প্রযুক্তি-প্রকৌশল ততটা আধুনিক করা যায়নি বলে। আমরা এখন কয়েক মাইল পর্যন্ত গর্ত বা সুড়ঙ্গ খুঁড়তে পারি।

আরও পড়ুন- সেই ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরি আবার জেগে উঠছে ইউরোপে

কিন্তু এই হিরেগুলির আঁতুড়ঘর যেখানে, ভূপৃষ্ঠ থেকে সেই ২২৪ থেকে ৪৪৬ মাইল (বা ৫০০ মাইল) পর্যন্ত গভীরতায় পৌঁছনোর মতো কোনও প্রযুক্তি-প্রকৌশল এখনও আমাদের আয়ত্তে আসেনি। আমাদের চার পাশে সাধারণ যে সব হিরে আমরা দেখতে পাই, সেগুলির ‘জন্মস্থান’ বড়জোর ভূপৃষ্ঠের ৯০ থেকে ১২০ মাইল নীচে। লক্ষ-কোটি বছর আগে ভয়ঙ্কর অগ্ন্যুৎপাতের দরুণ সেগুলি উঠে এসেছিল ভূপৃষ্ঠে। কিন্তু ‘কালিনান ডায়মন্ড’ আর ‘লেসোথো প্রমিস’-এর মতো দুর্মূল্য, দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ হিরেগুলির জন্ম হয়েছিল আরও অনেক গুণ বেশি গভীরতায়, পৃথিবীর ‘ম্যান্টলে’।’’ এই দুমূর্ল্য হিরেটির ওজন ৩,১০৭ ক্যারেট।

আরও পড়ুন- রাশিয়ার সবচেয়ে বড় হিরে খনি নিয়ে কিছু অবাক করা তথ্য


দুর্মূল্য, দুর্লভ সাদা হিরে


দুর্মূল্য, দুর্লভ নীলচে সাদা হিরে

কোন কোন ধাতুর স্রোত বয়ে চলেছে পৃথিবীর ‘ম্যান্টলে’?


কোথায় পৃথিবীর ‘কোর’, কোথায় ‘ম্যান্টল’

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে নিউইয়র্ক থেকে পারুল ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘লোহা, নিকেল, কার্বন, সালফার, মিথেন, হাইড্রোজেন ছাড়াও আরও বেশ কিছু মৌল ও ধাতু বা ধাতব পদার্থের গনগনে স্রোত (আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মতো) অবিরাম বয়ে চলেছে পৃথিবীর ‘ম্যান্টলে’। বড়, ভারী আর উজ্জ্বলতম হিরেগুলির খাঁজে খাঁজে আমরা সেই সব তরল ধাতু বা ধাতব পদার্থগুলিকে আটকে থাকতে দেখেছি। এটাই আমাদের জানতে, বুঝতে সাহায্য করেছে, সেগুলি কী ভাবে তৈরি হয়েছিল আর তা পৃথিবীর ঠিক কতটা গভীরতায় তৈরি হয়েছিল।’’


উত্তপ্ত ধাতুর স্রোত যে ভাবে বয়ে চলেছে ‘ম্যান্টলে’

দুর্মূল্য, দুর্লভ সাদা হিরে

যা ছিল শুধুই তত্ত্বে, তা-ই এ বার হল সত্য!

গবেষণাপত্রে মূল গবেষক ইভান স্মিথ লিখেছেন, ‘‘এত দিন নানা তত্ত্ব পৃথিবীর ‘ম্যান্টলে’ উত্তপ্ত ধাতুর স্রোত বয়ে চলার কথা বলেছিল। পূর্বাভাস দিয়েছিল। এ বার আক্ষরিক অর্থেই, তা হাতনাতে প্রমাণিত হল।’’

ছবি সৌজন্যে: ‘জেমোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অফ আমেরিকা’, নিউইয়র্ক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Largest Diamond Cullinan Diamond Mantle Diamond
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE