Advertisement
১৯ মে ২০২৪

তিনিও পরিব্রাজক

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ঘনিষ্ঠ শিষ্যদের এক জন। ব্রিটিশ-পুলিশ এককালে তাঁকে নজরবন্দি করে রাখে। স্বামী অখণ্ডানন্দর দেড়শো বছরে লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়রামকৃষ্ণদেবের তখন তিরোধান হয়েছে। গঙ্গাধর তখন সন্ন্যাসী, স্বামী অখণ্ডানন্দ তাঁর নাম। বয়স নিতান্তই কম, সবে কৈশোর উত্তীর্ণ হয়েছে তাঁর। বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাই, বিবেকানন্দ জানতেন তাঁর আচার্যদেব রামকৃষ্ণদেব এই ছেলেটিকে খুবই ভালোবাসতেন। তাঁর গুরুভাইদের মধ্যে এমন করে হিমালয় আর কেউ দেখেননি, এমনকী বিবেকানন্দ নিজেও না। সে যুগে হাতে গোনা কয়েকজন বাঙালির মাত্র এমন ‘হিমালয়ান’ অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রামকৃষ্ণদেবের তখন তিরোধান হয়েছে। গঙ্গাধর তখন সন্ন্যাসী, স্বামী অখণ্ডানন্দ তাঁর নাম। বয়স নিতান্তই কম, সবে কৈশোর উত্তীর্ণ হয়েছে তাঁর।

বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাই, বিবেকানন্দ জানতেন তাঁর আচার্যদেব রামকৃষ্ণদেব এই ছেলেটিকে খুবই ভালোবাসতেন।

তাঁর গুরুভাইদের মধ্যে এমন করে হিমালয় আর কেউ দেখেননি, এমনকী বিবেকানন্দ নিজেও না। সে যুগে হাতে গোনা কয়েকজন বাঙালির মাত্র এমন ‘হিমালয়ান’ অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

অখণ্ডানন্দের বাবা-মা থাকতেন কলকাতার আহিরীটোলায়, মানিক বসু ঘাট স্ট্রিটে। গঙ্গার ধারের সেই পাড়াতেই তাঁর জন্ম। কিছু দিন বাদে বাবা বাসাবদল করলেন। বাগবাজারের রাজপাড়া লেনের একটা বাড়িতে উঠে গেলেন তাঁরা।

কলকাতার রাস্তায় তখন নতুন পাইপ বসছে, লম্বা নলের এক দিকে শব্দ করলে অন্য দিকেও বেজায় আওয়াজ হয়। সে শব্দ কলকাতা আগে শোনেনি।

সভ্যতা যত এগোয় তত নতুন নতুন শব্দের জন্ম হয়। তিনি আর তাঁর দামাল সঙ্গীরা এমন শব্দ করে পথচলতি মানুষদের চমকে দিতেন।

স্কুল জীবন কাটিয়েছিলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। অবশ্য শব্দকল্পদ্রুমময় কলকাতায় তাঁর মন টিকত না। ঘরছাড়া সাধুদের পিছু নিতেন। পথ হাতছানি দিত।

তিনি গঙ্গাধর, তাঁর মন টানত হিমালয় – উত্তুঙ্গ নিঃস্তব্ধ ধ্যানগম্ভীর হিমালয়।

রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে তাঁর, গঙ্গাধর নামের ছেলেটির, প্রথম দেখা ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। তারপর মাঝেমাঝেই দক্ষিণেশ্বরে যেতেন। ছেলেটির অবিন্যস্ত চুল, কমনীয় মুখশ্রী।

গরমকালের এক শনিবার, গঙ্গাধর রামকৃষ্ণের কাছে এসেছেন। সে সময় কলকাতায় দু-পয়সায় এক সের বরফ পাওয়া যেত।

পরমহংস গঙ্গাধরকে একটু বরফ আনতে বললেন। পথে বেরিয়েই গঙ্গা দেখেন দক্ষিণেশ্বরের দিকে আসছেন এক বরফওয়ালা। সেদিন সহজেই নগরে কেনা বরফ মিলল। কিন্তু বরফ কেনা আর বরফ দেখা তো এক কথা নয়।

গঙ্গাধরের জীবনে হিমালয়ের টান মিথ্যে হয়নি, বরফ দেখার পর্বটি এসেছিল পরে। সে যেমন তেমন বরফ নয়। হিমালয়ের পথে পথে বরফময় শৃঙ্গের আনাচ-কানাচের মধ্য দিয়ে তিব্বতের দিকে তাঁর যাত্রা।

এমনিতে হিমালয়ের প্রতি বাঙালিদের বেশ একটা দুর্বলতা আছে – নগাধিরাজ হিমালয়, আর রহস্যময় তিব্বত কাকে না টানে! সুকুমার রায়ের হযবরল-এর ঘামমোছা রুমাল থেকে হয়ে ওঠা বেড়াল বিশ শতকে বলেছিল , ‘গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পার।’ তিব্বত যাওয়ার পথটাও বলতে কসুর করেনি সে ‘কলকেতা, ডায়মণ্ডহারবার, রাণাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্‌। সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হল।’

তিব্বত কি আর শুধু তিব্বত! শুধু কি একটা জায়গার নাম ! মোটেই না। তিব্বত একটা আশ্রয়, ভাবনা, ‘কনসেপ্ট’ । তার মধ্যে আবার রহস্য-জটিলতা-রাজনীতি। হিমালয়ের পথে পথে তিব্বত । পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সেখানে নানা স্বপ্ন, মায়া ও কুহকের ওঠা পড়া । সাধে কী অবন ঠাকুর তাঁর ‘বুড়ো আংলা’য় গেয়ে রেখেছিলেন ‘কোনোদিন ভুলো না যে পৃথিবীর সেরা হচ্ছে এই হিমালয়, আর সেইটে ভগবান দিয়েছেন তাঁর কালো ছেলেদের।’

অবন ঠাকুরের এই কালো ছেলেদের ভগবান দিয়েছেন হিমালয় কথাটা যেন বীজমন্ত্রের মতো। অবধারিত ভাবে মনে পড়ে যায় গঙ্গাধরের, স্বামী অখণ্ডানন্দের কথা।

গঙ্গাধরের হিমালয় যাত্রার কথা শোনার আগে অবশ্য ইতিহাস ভূগোল একটু জানা চাই । এমনিতে উনিশ শতকের ভারতীয় তিব্বতযাত্রীদের মধ্যে শরৎচন্দ্র দাস আর কিন্টুপের নাম বেশ পরিচিত। পরিমল ভট্টাচার্য মশাই শাংগ্রিলার খোঁজে নামে একটি বইতে সম্প্রতি এঁদের কথা চমৎকার লিখেছেন। এঁরা দুজনেই ব্রিটিশ গুপ্তচর হয়ে তিব্বতে প্রবেশ করেছিলেন।

শরৎচন্দ্র দাস ছিলেন দার্জিলিং-এর ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলের হেডমাস্টার। তাঁর তিব্বত ভ্রমণের ফলশ্রুতি দুটি বই, জার্নি টু লাসা অ্যান্ড সেন্ট্রাল টিবেট (১৮৮১), টিবেটান-ইংলিশ ডিকশনারি, উইথ স্যান্সক্রিট সিনোনিমস (১৯০২)। শরৎচন্দ্রকে দার্জিলিং-এ পাঠানোর পেছনে যে সাদা-সাহেবদের গোপন অভিসন্ধি কাজ করছে শরৎচন্দ্র প্রথমে তা অবশ্য জানতেন না।

কেন গুপ্তচর?

ম্যাপের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে তিব্বতের ভৌগোলিক অবস্থান কূটনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের ওপর দখলদারি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রাশিয়া ও চিনের ওপর যে এক হাত নেওয়া যাবে এটা ব্রিটিশ সাদা-সাহেবরা জানতেন। এছাড়া বাণিজ্যের সুবিধে তো পাওয়া যাবেই। ফলে ব্রিটিশরা তক্কে তক্কে থাকতেন।

উত্তর ভারতের পাহাড়ি মানুষদের বণিক-পরিব্রাজক সাজিয়ে তাই তিব্বতে পাঠাতেন ব্রিটিশরা, কিন্তু তাঁরা কেউ শিক্ষিত ইনফর্মার নন। তিব্বতের ভাষা-সংস্কৃতি-পথঘাট জরিপ করে এসে জানানোর মতো পড়াশোনা ও সামর্থ্য তাঁদের নেই। এদিক থেকে শরৎচন্দ্র দাসের মতো শিক্ষিত ভদ্রলোক বাঙালির ইনফর্মার হিসেবে জবাব নেই ।

কিন্টুপও সাদা সাহেবদের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন, তবে শরৎচন্দ্রের মতো স্বীকৃতি তাঁর মেলেনি। দর্জি কিন্টুপ আর বাঙালি ভদ্রলোক শরৎচন্দ্র দাস দুজনের মধ্যে কি কোনও তুলনা চলে?

১৯০৩-এ বিশ শতকে ব্রিটিশ সৈন্য যখন তিব্বত আক্রমণ করে তখন শরৎচন্দ্র আর অপরাপর গুপ্তচরদের তিব্বত সম্বন্ধীয় খবরাখবর তাদের খুবই কাজে লেগেছিল।

তবে তিব্বতে সেনা ঢুকিয়ে দেওয়ার পর ব্রিটিশ রাজ আর উনিশ শতকীয় গুপ্তচরদের কথা মনে রাখতে চায়নি। রায়বাহাদুর শরৎচন্দ্র দাসের নাম হারিয়ে গিয়েছিল।

গঙ্গাধর কিন্তু আমাদের কালো ছেলে, ভালো ছেলে। সন্ন্যাসী তিনি। সাহেবি গুপ্তচর হয়ে তিনি কি তিব্বতে যেতে পারেন!

তাঁর তিব্বত ভ্রমণের কাহিনি ‘তিব্বতে তিন বৎসর’ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় । সেই সময় ব্রিটিশরাজের তিব্বত অভিযান টাটকা খবর। ফলে তিব্বতভ্রমণের কাহিনি পাঠকদের আগ্রহ উসকে দিয়েছিল।

স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছিলেন, ‘তিব্বত লইয়া আজকাল চতুর্দিকে ঘোর আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে, তাহারই সম্বন্ধে দুই চারিটি কথা এই সময়ে সাধারণে প্রকাশ করিলে বোধ করি নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হইবে না।’

গঙ্গাধর যখন প্রথম তিব্বত ভ্রমণ করেন তখন তাঁর বয়স সতেরোর মতন। ১৮৮৭-৯০ এই পর্বের নিজের ভ্রমণ কথা তিনি কিন্তু উনিশ শতকে সর্বসাধারণের জন্য লেখেননি।

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রমদাবাবুকে লেখা বিবেকানন্দের একটি চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে গঙ্গা বিবেকানন্দকে একটি পত্রে তিব্বতের কথা লিখেছেন। বিবেকানন্দ আরও জানতে চান। গঙ্গাকে লেখেন, ‘তিব্বতী লোকদের আচার-ব্যবহার তুমি তো কিছুই লিখ নাই… সবিশেষ লিখিবে – সকল কথা খুলিয়া একখান বৃহৎ পত্রে।’

পরে অবশ্য অবস্থা বদল হল। গঙ্গাধরকে তিব্বতীরা ও ব্রিটিশরা উভয়েই সন্দেহের চোখে দেখে। কাশ্মীরে গঙ্গাধর মহারাজ বিনা কারণে পুলিশের নজরবন্দি ছিলেন।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে ব্রিটিশের সন্দেহ গেল। তিব্বত ভ্রমণের পর কলকাতায় ফিরে এলে নানা জন তাঁর কাছ থেকে রহস্যময় অজানা তিব্বতের কথা জানতে চাইতেন। বিবেকানন্দ জানতেন ব্রিটিশভারতে তিব্বত সম্বন্ধীয় খবরের মূল্য ও গুরুত্ব।

রাজনৈতিক অভিসন্ধির শিকার হন গঙ্গাধর, বিবেকানন্দ তা মোটেই চাননি। কাজেই গুরুভাইকে মুখে কুলুপ আঁটতে বলেছিলেন। আর গঙ্গাধরের জন্য কি দলনেতা বিবেকানন্দকে কম লড়তে হয়েছিল!

কয়েক বছর হিমালয়ের পথে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, তিব্বতঘোরা পরিব্রাজক সন্ন্যাসী গঙ্গাধরকে নিয়ে অনেকেই আজে-বাজে কথা বলেছিলেন।

বিবেকানন্দ কিন্তু বরাবরই তাঁর প্রিয় গঙ্গার পক্ষে। যখন ১৯০৪-এ গঙ্গাধরের ভ্রমণকাহিনি উদ্বোধনে প্রকাশিত হচ্ছে তখন বিবেকানন্দ প্রয়াত, তিব্বতও অগম্য নয়, ব্রিটিশ ফৌজ সেখানে ঢুকেছে।

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণদেব প্রয়াত হলেন। তার সাত আট মাস পরে বরানগর মঠ থেকে তাঁর শিষ্যরা অনেকেই একে একে বেরিয়ে পড়লেন ভারতভ্রমণে।

উদ্দেশ্য দেশ দেখা, দেশ চেনা। ১৮৮৭-র ফেব্রুয়ারি মাসে অখণ্ডানন্দ রওনা দিলেন হিমালয়ের দিকে। তিব্বত যাওয়া যে সহজ কাজ নয় তা তাঁকে বলেছিলেন এক বাঙালি সাধু । তিনি থাকতেন কেদারের পথে ফাটাচটিতে। শরৎচন্দ্র আর কিন্টুপের থেকে অখণ্ডানন্দের যাত্রাপথ আলাদা।

ফাটাচটির সাধু তিব্বতে গিয়ে কৈলাস আর মানস সরোবর দেখে এসেছিলেন। রানাঘাট থেকে তিব্বত যে সিধেরাস্তা নয়, সওয়া ঘন্টার পথও নয়, এ সত্য ফাটাচটির সাধুর বিলক্ষণ জানা ছিল।

অখণ্ডানন্দকে তাই তিনি বললেন, ‘মান্‌ সরোবর কোন্‌ পর্‌সে, বিনা বাদর হিম বর্‌সে, উড়ত কঙ্কর জীব তর্‌সে।’ মানস সরোবরে বৃষ্টি পড়ে না, শুধুই তুষারপাত হয়। ঝোড়ো হাওয়ায় পাথর উড়ে গিয়ে আঘাত করে যাত্রীদের। এই ভয়ংকর-সুন্দর মানস সরোবরের স্পর্শ এক-দুজন ভাগ্যবানই পেয়ে থাকেন। দুর্গমতার ভয় দেখিয়ে অবশ্য তাঁদের আটকানো যায় না— যাঁদের পাহাড় টানে তাঁরা ঠিক তিব্বতে পৌঁছে যান।

কেন এই পার্বত্য হিমালয় আর দুর্গম তিব্বতে যেতে চেয়েছিলেন গঙ্গাধর? কী টেনেছিল তাঁকে? ধনের নেশা বা অভিযাত্রী হিসেবে নাম কেনার মোহ ছিল না তাঁর। তিনি দু-চোখ ভরে দেখতে চেয়েছিলেন। হিমালয় যেন পুরুষ, বৃক্ষলতা ফুলফল যেন প্রকৃতি।

বাঙালি সন্ন্যাসীর কানে গান ভাসে, পুরুষ-প্রকৃতির গান, ‘বাজবে গো মহেশের বুকে, নেমে দাঁড়া, আর নাচিস নে খ্যাপা মাগী ।/ মরে নাই শিব বেঁচে আছেন, মহাযোগে আছেন যোগী’। সাদা, শুভ্র, স্তব্ধ হিমালয়। তার ওপর সবুজের কারুকার্য। সেই অপরূপ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আমাদের কালো ভালো ছেলে গঙ্গাধর সাহেবি ভাবনার সমালোচনাও করছেন। এই অপরূপ প্রকৃতির বুকে দাঁড়িয়ে মানবজীবন তুচ্ছ মনে হয় তাঁর। কত সন্ন্যাসী তো এই হিমালয়ের বুকে প্রাণত্যাগ করেছেন। পর্বত থেকে লাফ দিয়ে সেই অপরূপ আত্মহননকে কীভাবে বিচার করবে সভ্যতা ? এ কি সাহেবি মতে জীবনের অধিকার ত্যাগ, না কি ভয়ংকর সুন্দরের মধ্যে মিশে যাওয়ার বাসনা । হিমালয় আর তিব্বত যেন পুরুষ-প্রকৃতির কুহক নিয়ে সবছাড়া ভারতীয় সন্ন্যাসীদের কাছে টেনে নেয়— সেখানেই একান্তে ধ্যান, সেখানেই স্বেচ্ছামৃত্যু, ভৃগুপতন।

এই অপরূপকে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন যে বাঙালি যুবা তিনি কি সাম্রাজ্যবাদী অভিপ্রায়ের তালে তাল মেলাতে পারেন! অখণ্ডানন্দের লেখা উদ্বোধনের ভ্রমণকাহিনি পরে তিব্বতের পথে হিমালয়ে নামে বই হয়েছিল।

সে-বই পড়লেই বোঝা যায় সব অভিজ্ঞতা পরিণত সন্ন্যাসী সেখানে লেখেননি। অন্নদানন্দ স্বামী অখণ্ডানন্দ নামে যে জীবনী গ্রন্থ লেখেন তাতে পরিপূরক তথ্য মেলে।

তিব্বত থেকে ফেরার পর ব্রিটিশ কাশ্মীরে গঙ্গাধর নজরবন্দি হলেন। এই যুবা-সন্ন্যাসী কী উদ্দেশে তিব্বতে গেছিলেন তা জানতে চায় থানা। শেষে রেসিডেন্ট নিস্‌বেট কলকাতায় খোঁজ-খবর নিয়ে গঙ্গাধরকে ছেড়ে দিলেন।

তবে ছাড়ার আগে লোভ দেখাতে ছাড়েননি। তিব্বতে গঙ্গাধরকে সরকার দূত করে পাঠাতে চেয়েছিলেন।

দূত না গুপ্তচর? তিব্বতীদের সম্বন্ধে খোঁজ-খবর জানতে চেয়েছিলেন তাঁর কাছে। গঙ্গাধরের সাফ জবাব ‘একটি নিরীহ নিরুপদ্রব স্বাধীন জাতির সর্বনাশ’ তিনি করতে পারবেন না। হিমালয়ের রূপে মজেছেন যে সন্ন্যাসী তাঁর কাছে এসব তুচ্ছ। একবার নয়, বারবার তিনবার তিব্বতে গিয়েছিলেন তিনি।

সেই অভিযাত্রায় তিনি শুধু হিমালয়ের রূপই দেখেননি, মানুষের ন্যায়-অন্যায় দুই দেখেছেন।

থুলিং মঠে লামাদের কাছে এই সন্ন্যাসী ‘গে-লাম্‌’ বা অখণ্ড ব্রহ্মচারী হিসেবে বিশেষ সম্মান পেয়েছিলেন। বিবেকানন্দ গঙ্গাকে তন্ত্রাচারী তিব্বতীদের সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিলেন। মঠের ঐশ্বর্য ও লামাদের বৈভবের পাশাপাশি সাধারণ তিব্বতীদের দারিদ্র দেখে বিচলিত হয়েছেন গঙ্গাধর।

এই অসামঞ্জস্য নিয়ে কথা বলায় লামারা তাঁর ওপর বিরক্ত। প্রাণসংশয়ও হয়েছে। একবার শিপছিলাম পাস দিয়ে তিব্বতের দাবা জেলায় প্রবেশ করলেন তিনি। লাসা যাওয়ার ইচ্ছে। স্থানীয়রা আটকালো, ভাবল ব্রিটিশের চর। লাসা যাওয়ার অনুমতি মিলল না তবে কৈলাস-মানস দর্শন হল। অখণ্ডানন্দ লিখছেন, ‘তিব্বতীয়দের সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হয়। …তিব্বতীয় ভাষায় আমার মনের ভাব তাহাদিগকে সুন্দররূপে বুঝাইতে পারিতাম।’ অখণ্ডানন্দের ভ্রমণকাহিনি শেষ হয়েছে এক ‘কাঞ্চনাসক্ত’ সাধুর কথায়। লোহার চিমটেকে সেই সাধু ক্রমাগত পাহাড়ের গায়ে ঠোকে। আর হাহাকার করে বলে লোহা কেন সোনা হচ্ছে না।

অবাক অখণ্ডানন্দ লিখেছেন, ‘হিমালয় দর্শন করিয়া যে অপার আনন্দ তাহার তুলনায় স্পর্শমণি যে অতি তুচ্ছ’ । লোভী সাধু তা বোঝেন না।

গঙ্গাধর বুঝতেন। গঙ্গাধরের ঠাকুর পরমহংস তাঁর কথামৃত-য় বলেছিলেন শকুনের কথা। — সে পাখি কত উপরে উঠেছে কিন্তু চোখ সেই ভাগাড়ের দিকে। হিমালয়ে উঠলেই মন খোলে না।

কিন্তু গঙ্গাধরের অবশ্যই খুলেছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE