Advertisement
১৯ মে ২০২৪
Art

‘চেতনা বিক্ষিপ্ত ধূলিকণা যা নীলাভ তাই নীল নয়’

অতীন বসাক সরাচিত্রে নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর সৃষ্ট পাঁচটি দেবীমুখে। মুকুট, চোখ, অত্যল্প নকশাময় শৃঙ্খলাবদ্ধ রচনায় যা অনবদ্য।

পটে আঁকা: নন্দলাল বসুর জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত সরাচিত্রের প্রদর্শনী

পটে আঁকা: নন্দলাল বসুর জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত সরাচিত্রের প্রদর্শনী

অতনু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২২ ০৭:২২
Share: Save:

সরায় আঁকা ষোলো জনের ৭৩টি কাজ। এ ধরনের ছবির চাহিদা আছে। সরায় আঁকা ছবির এক মহার্ঘ সংকলন নিয়ে কে. জি. সুব্রহ্মণ্যমের বৃহৎ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল রাজধানীর এক নামী গ্যালারির প্রকাশনায়। এক সময়ে সাধারণ সরাচিত্রে দেবদেবী ও লোকশিল্পমণ্ডিত ছবির খুব চাহিদা ছিল। পুরাণভিত্তিক বিভিন্ন কাজ, সামাজিক নানা ঘটনার সন্নিবেশকেও গ্রামীণ লোকশিল্পীরা পটচিত্রের মতো সরাতেও কিছু কাজ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নগরসভ্যতা, গ্রাম্য লৌকিক সব উপচার, পার্বণ, ধর্মীয় ঘটনাও সরাতে এসেছে চিত্রকলার মাধ্যমে। ধীরে ধীরে একটি নিরীক্ষাজাত স্টাইলও শিল্পীরা সরাচিত্রে ব্যবহার করেছেন।

নন্দলাল বসুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘দেবভাষা’ সরাচিত্রের এক প্রদর্শনী তাদের গ্যালারিতে আয়োজন করেছিল। তবে প্রদর্শনীতে অনেক কাজই দায়সারা গোছের। সরাটিকে প্রাথমিক ভাবেই ছবি করার উপযোগী পদ্ধতির মাধ্যমে তৈরি করা আবশ্যিক। অনেকে এই জায়গাতেই বিবিধ পরীক্ষা করেন। দেখা গেছে, টেক্সচারে মজা ও কায়দা আনতে বাড়তি কিছুর সংমিশ্রণ, সংযোজন করা হচ্ছে। নেপালি কাগজ আটকেও ছবি করা হচ্ছে। অ্যানালিটিকাল কিউবিজ়মে যেমন বাড়তি উপকরণ ক্যানভাসে ব্যবহারের চেষ্টাও হয়েছে পাশ্চাত্যে।

সরার বর্তুলাকার গঠনের সীমাবদ্ধতাকে রেখেই রচনাটি সম্পন্ন হয়। সেখানে অনেকেই আলঙ্কারিক, নকশাময় কাজ থেকে অনেকটাই আবার আধুনিকতার আবহে রূপবন্ধ ও অন্য বিষয়গুলি নিয়েও পরীক্ষা করেন। আসলে সরা মাধ্যমটিকে কতটা দৃষ্টিনন্দন করা যায়, শিল্পীদের কাছে তখন এটাই প্রধান।

সরাচিত্রে গণেশ হালুইয়ের সাদাকালো রচনাগুলির যে সরলীকৃত রূপ, সেখানে প্রতীকের মতো রূপবন্ধের উদ্ভব হয়েছে। অনেকটা স্পেস রাখা রচনাগুলিতে ওই বর্তুল সৌন্দর্যের অন্বেষণে তিনি নিজের মতো জ্যামিতি প্রত্যক্ষ করিয়েছেন। এখানে মোটিফ, লতাপাতা, সরলরেখার বিভাজন, অচিরে ঘূর্ণায়মান বা ঘুরিয়ে দেওয়া কিছু লাইনের সঙ্গে রূপবন্ধের একটি নকশাময় প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। অতি সামান্য হালকা সবুজ ও লালচে বর্ণের ব্যবহার ছবিকে অনন্য করেছে। নকশার ঐশ্বর্য, মাঙ্গলিক চিহ্ন অনেক সময়ে ছবিরও ঐশ্বর্য
হয়ে ওঠে।

কে. জি. সুব্রহ্মণ্যমের ড্রয়িংভিত্তিক দ্বিবর্ণরঞ্জিত চিত্রটি অসামান্য কিছু কৌতূহলের উদ্রেক করে। ব্যঙ্গাত্মক অর্থে বা রূপক অর্থে হলেও। কালো মোটা রেখায় করা দ্রুত ড্রয়িংগুলি যোগেন চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত সরলীকরণের প্রতিরূপ। সাদা কালো বিন্যাস ও হালকা রচনার বাইরে অন্য কোনও গূঢ় তত্ত্ব নেই।

শেখর রায় স্বল্প নির্বাচিত সাদা-কালো, কমলা-খয়েরি, ছাই বর্ণে বেশ ভাল কাজ করেছেন। কৃষ্ণেন্দু চাকীর বর্ণোজ্জ্বল এক দেবীরূপের চার ভিন্ন রচনায় অসুরদমনের চিত্রের মুহূর্তগুলি অতি দৃষ্টিনন্দন। সুলেখক, চিত্রকর, গবেষক সুশোভন অধিকারী সরায় বেশ প্রত্যয়ী ও সংবেদনশীল প্রতিকৃতি এঁকেছেন। সূক্ষ্ম আঁচড়ের এই দৃষ্টিনন্দন স্ট্রোকে মূর্ত হয়েছেন রবীন্দ্র-অবনীন্দ্র-রামকিঙ্কর-নন্দলাল প্রমুখ।

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজস্ব স্টাইলের বিহঙ্গকুল, ষাঁড়, বেড়াল ইত্যাদির টেকনিক, ব্রাশিং, বর্ণের ঘষামাজা প্রয়োগ, দ্রুত সাদা ব্রাশিংয়ে মুরগির মুহূর্তটি
আপ্লুত করে।

প্রদর্শনীটিতে সরাচিত্রে বর্ণ প্রয়োগের ও রচনার দিকটি নিয়েও অনেকেই বিমূর্ত, আধাবিমূর্ত ও স্বাভাবিকতার আবহেই একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে কাজ করেছেন। পেন্টিং কোয়ালিটি যেমন কমবেশি দেখা গিয়েছে, বর্ণের গাঢ়ত্ব, ঔজ্জ্বল্য, ধূসরতা ও ক্রমশ অপস্রিয়মাণ বর্ণ ও আলোর অমন দোদুল্যমানতাও লক্ষণীয়। রচনার সঙ্গে কতটা তা যাচ্ছে বা আদৌ গিয়েছে কি না, সে প্রশ্ন তখন অবান্তর। চটজলদি কাজের প্রবণতার পাশাপাশি ধরে ধরে প্রায় খুঁতহীন একটা উচ্চতায় ছবিকে নিয়ে যেতেও চেয়েছেন কেউ কেউ। বর্ণের ছায়াতপ, রেখার তীব্রতার আভাস, ভারসাম্যেরও সহাবস্থান, অস্থিরতা, এমনকি দৌর্বল্যও চোখে পড়েছে। অতি আধুনিকতা যেমন ছিল, তা থেকে সরে এসে ঐতিহ্য ও আধুনিকতারই এক সরলীকরণ প্রক্রিয়ায় একটা চমৎকার গাঠনিক প্রয়াসও কাজ করেছে। আধুনিকতার বিন্যাসকেও যৎসামান্য বর্ণ ও রূপবন্ধের ফর্মে ফেলে কেউ আবার প্রতীকায়িত করেছেন বিমূর্ততায়।

অতীন বসাক সরাচিত্রে নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর সৃষ্ট পাঁচটি দেবীমুখে। মুকুট, চোখ, অত্যল্প নকশাময় শৃঙ্খলাবদ্ধ রচনায় যা অনবদ্য।

প্রায় কাহিনিনির্ভর না হলেও, কনটেন্টকে যেন গুরুত্বই দিয়েছেন ছত্রপতি দত্ত। অবয়বপ্রধান রচনায় এই রিয়েলিজ়ম প্রাণিত করে। বড্ড নাটকীয় ছবি। ড্রয়িংয়েও দারুণ একটা আবহ জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর কাজে।

বিমল কুণ্ডু ছোট্ট দেবীমুখকে ঘোর কালো সরার মাঝে চমৎকার ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। অলয় ঘোষালের গাছের ডালে বসা পেঁচা ও চাঁদ নিয়ে কম্পোজ়িশনটি অসাধারণ। এ ছাড়া রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, হিরণ মিত্র, প্রদীপ রক্ষিত, শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের কাজও ছিল। তা সত্ত্বেও এ প্রদর্শনী তেমন দাগ কাটতে পারেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Art Nandalal Bose
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE