Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪
Mephisto

চিরকালীন দ্বন্দ্বের নির্মম আয়না

প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, কে এই মেফিস্টোফিলিস? ইয়োরোপীয় সাহিত্যে এর প্রভাব কী ভাবে তৈরি হল? মূলত দু’টি নাটক মেফিস্টোফিলিস চরিত্রটিকে ইয়োরোপীয় চেতনায় বিশেষ ভাবে প্রোথিত করে।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও অনির্বাণ চক্রবর্তী।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও অনির্বাণ চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।

সৌভিক সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:১৫
Share: Save:

মধুসূদন মঞ্চে ১ মার্চ মুখোমুখি নাট্যোৎসবে মঞ্চস্থ হল চেতনা, মুখোমুখি ও তৃতীয় সূত্রর যৌথ প্রযোজনায়— মেফিস্টো।‌ অনুবাদ ও নির্দেশনা সুমন মুখোপাধ্যায়। ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গার সময় থেকে এই নাটকটি উপস্থাপিত হয়ে আসছে। এই নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে একটি মূল ভাবনা— শিল্পী ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের সমীকরণ। সুমন মুখোপাধ্যায়ের মেফিস্টো নাটকটি আধারিত হয়েছে জার্মান লেখক ক্লাউস মানের ‘মেফিস্টো’ নামের মূল উপন্যাস ও আরিয়ান নুশকিনের নাট্য-অ্যাডাপটেশনের উপর।‌ এর সঙ্গে এসে মিশেছে হাঙ্গেরীয় চলচ্চিত্রকার ইস্তেভান স্যাবোর চিত্রনাট্যর প্রভাব।

প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, কে এই মেফিস্টোফিলিস? ইয়োরোপীয় সাহিত্যে এর প্রভাব কী ভাবে তৈরি হল? মূলত দু’টি নাটক মেফিস্টোফিলিস চরিত্রটিকে ইয়োরোপীয় চেতনায় বিশেষ ভাবে প্রোথিত করে। প্রথমটি হল ইংরেজ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লোর ‘ডক্টর ফসটাস’ (১৫৯২-৯৩) এবং দ্বিতীয়টি হল ইয়োহান গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ (১৮০৮, ১৮৩২)। এই দু’টি নাটকেই দেখা যায় যে ফস্টাস বা ফাউস্ট একজন বিদ্বান ব্যক্তি। তিনি ইহলোকে বিত্ত, ক্ষমতা, উচ্চতর অভিজ্ঞতা ইত্যাদি প্রাপ্তির জন্য নরকে শয়তানের সহচর ‘মেফিস্টোফিলিস’-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন এবং এর পরিণামে তাঁর আত্মিক ও মানসিক অধঃপতন দেখা যায়। সুতরাং মেফিস্টোফিলিস ইয়োরোপীয় চেতনায় মানুষের নৈতিক ও আদর্শগত অধঃপতনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বহুকাল। ‘মেফিস্টো’ নাটকও পুনরায় অধঃপতনেরই কথা বলে। কিন্তু এ বার তা এক নাট্যকর্মী হেন্ডরিখ হফগেন-এর অধঃপতন।‌ সময়কাল, নাৎসি-পুর্ববর্তী জার্মানি থেকে নাৎসি-অধিকৃত জার্মানি।

নাটকের দৃশ্যে সুজন- অনিবার্ণ।

নাটকের দৃশ্যে সুজন- অনিবার্ণ। —নিজস্ব চিত্র।

১৯২০-র দশক। জার্মানির হামবুর্গ থিয়েটারের এক তুখোড় নাট্যকর্মী হেন্ডরিখ হফগেন। সে কমিউনিস্ট ভাবধারার লোক। সে নাৎসিদের ঘৃণা করে। অথচ যখন নাৎসিরা ক্ষমতায় এল তখন সে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিনয় করতে লাগল এবং গ্যেটের ফাউস্ট নাটকে ‘মেফিস্টো’র চরিত্র করে সে বিস্তর খ্যাতিলাভ করল। এর জন্য সে ত্যাগ করল তার আদর্শ, তার বিশ্বাস ও তার বন্ধুদের। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সেই বলয়ে বিচরণ করাই তার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াল। এই ভাবে ‘মেফিস্টো’ নাটকটি হয়ে উঠল এক অভিনেতার চরম নৈতিক অধঃপতনের আখ্যান—যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় স্বৈরাচারী রাষ্ট্র, রাজনীতি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিল্পীর জটিল ও পঙ্কিল সম্পর্ক। মেফিস্টো আয়নার মতো এই সময়কেও প্রতিফলিত করে। এখানেই তার অন্তর্নিহিত বিশিষ্টতা।

মেফিস্টো নাটকটিতে বহু প্রসিদ্ধ নাট্যাভিনেতা অভিনয় করেছেন। কেন্দ্রীয় চরিত্র হেন্ডরিখ হফগেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। হেন্ডরিখের আদর্শবাদ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার সংঘাত এবং ক্রমশ‌ তার নৈতিক পতনকে দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন তিনি। এর পাশাপাশি হান্স মিকেলাসের ভূমিকায় ঋদ্ধি সেন ও অটো উলরিখস-এর চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তীর ধারালো অভিনয় নাটকটিকে গভীরতর মাত্রা প্রদান করেছে। হেন্ডরিখ হফগেনের হান্স মিকেলাসকে অপমান করার দৃশ্যটি তীব্রতার সঙ্গে অভিনীত হয়েছে।‌ পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের সাবলীল অভিনয়-মুদ্রা, সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমা ও সুজন মুখোপাধ্যায়ের স্বচ্ছন্দ অভিব্যক্তি ভাল লেগেছে। এছাড়া লোকনাথ দে, নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত ও বাসুদেব মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় নাটকটির অন্তর্নিহিত চাপানউতোরকে দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেছে।

‘মেফিস্টো’ নাটকের প্রাণ হল তার তীব্রতা। সমগ্ৰ নাটকটি যাতে একটি বৃহৎ চাবুকের মতো এসে পড়ে দর্শকের চেতনায়, পরিচালক হিসেবে সেই কাজটিই অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন সুমন মুখোপাধ্যায়। এই নাটকের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তু হল ‘আয়না’। এই আয়নাটিতে মানুষ নিজের মুখ দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিন নিজের ভিতরটাও দেখতে পায়। আর সেখানেই সে নিজেই নিজের সঙ্গে এক অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ‘আয়না’র ব্যবহার এই নাটকটিকে প্রতীকপৃথিবীর গোধূলিতে এনে দাঁড় করিয়েছে।

সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চ, দীনেশ পোদ্দারের আলো, প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গীত, সুদীপ গুপ্তর মাপেট ও মহম্মদ আলীর রূপসজ্জা মেফিস্টোর মূল স্বাদটিকে অকপটে তুলে ধরেছে। যেখানে একটি গোটা নাটকের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে একটা চিৎকার, একটা আর্তনাদ, ভয়ের পরিবেশ, সেখানে কোনও একটিও বিভাগে খামতি থাকলে চলে না। সুমন মুখোপাধ্যায় বহুদিন ধরে ‘মেফিস্টো’ মঞ্চস্থ করে চলেছেন এবং তিনি জানেন, ঠিক কোথায় কখন রক্ত চলকে ওঠে, ঠিক কোথায় নিজেরই অজান্তে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোনোর সময় দর্শকের মাথার ভিতরে, স্বপ্ন নয়, কোনও এক ‘মেফিস্টো’ কাজ করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drama Artist drama Theatre Group Group Theatre
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE