২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর প্রেক্ষাগৃহে পালিত হল সায়ক নাট্যগোষ্ঠীর সুবর্ণ নাট্য উৎসব। এর মধ্যেই ২ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হল সায়কের অতি জনপ্রিয় নাটক ‘দায়বদ্ধ’। এই নাটকটির নাট্যকার চন্দন সেন। নির্দেশক মেঘনাদ ভট্টাচার্য। নাটকটি ১৯৯১ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয় এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য বার তা অভিনীত হয়েছে। সেই সংখ্যাটা সাতশোর বেশি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, এই নাটকটি দর্শকের ভিতরে গত তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। তার মূল কারণ হিসেবে দু’টি বিষয় উল্লেখ্য— এক, নাট্যবস্তু এবং দুই, মেঘনাদ ভট্টাচার্যের অভিনয়। এ বারেও এর অন্যথা হয়নি।
‘দায়বদ্ধ’ নাটকটির কেন্দ্রে প্রোথিত রয়েছে পিতৃত্ব ও মনুষ্যত্বের কিছু মূল জিজ্ঞাসা। সন্তান কে? পিতা কে? রক্তের সম্পর্ককে অতিক্রম করে এক গোধূলিমলিন আকাশের নীচে একটি অশ্বত্থ গাছের ছায়ার আড়ালে যে পুরুষ একরাশ স্নেহ আর ভালবাসা নিয়ে কাঙালের মতো অন্যের ঔরসজাত সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে, সে কি পিতা নয়? যে পুরুষ অপর ঔরসজাত সন্তানকে নিজের সমস্ত কিছু দিয়ে ভালবাসে, সে কি যথেষ্ট পিতা নয়? পিতৃত্বের সংজ্ঞা স্থির করবে কে? সমাজ নামক একটি বায়বীয় ভাবনা? ঠিক এই জায়গাটিকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় একটি বিরাট দ্বন্দ্ব। ভেঙে যায় ঘরের প্রচলিত ধারণা। ফাটল তৈরি হয় রক্ত আর ভালবাসার ভিতরে। অপর পক্ষে যে জন্মদাত্রী, সে-ও তো তার গর্ভজাত সন্তানের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষায় নির্দয় হবে। যাতে সন্তানের ভাল হয়, যেখানে গেলে সন্তান ভাল থাকে—সেই জায়গার কথাই সে ভেবে যাবে। কিন্তু সেই ভাবনার পরিধি যদি অতিশয় সংকীর্ণ হয়ে ওঠে, তখন? তখন কি এটা সমর্থনযোগ্য? চন্দন সেন রচিত এই নাটকের নাট্যবস্তুর মধ্যেই যে তীব্র দ্বন্দ্বের আভাস রয়েছে, তা দর্শকের আবেগের স্রোতে গিয়ে আঘাত করে।
এই নাটকটি ১৯৯১ থেকেই মেঘনাদ ভট্টাচার্য করে আসছেন। লরি ড্রাইভার গগনের চরিত্রে তাঁর এই অভিনয় একটি ‘আইকনিক’ পারফরম্যান্স। একটি চরিত্রের সঙ্গে বহুকাল বসবাস করলে, অভিনেতাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তার ব্যক্তিসত্তা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় অভিনয়ের সময়ে। এ ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। নাটকে আমরা অভিনেতাকে নয়, গগনকেই পেয়েছি। তার আর্তনাদ ও কান্না, স্নেহ ও আনন্দ, খামখেয়ালিপনা ও তীক্ষ্ণতা—এই সব ক’টি অভিব্যক্তি অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন মেঘনাদ ভট্টাচার্য। পাশাপাশি গগনের জীবন-সঙ্গিনী সীতার চরিত্রে রুনা মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ও প্রশংসনীয়। সীতা চরিত্রের নানা পরত, অসহায়তা, আতঙ্ক সুষ্ঠু ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রুনা। কন্যা ঝিনুকের ভূমিকায় রিমঝিম ঘোষ সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। বহুদিন ধরে হয়ে আসা জনপ্রিয় নাটকের কোনও চরিত্রে অভিনয় করার একটা সমস্যা হল, যিনি নবাগত বা নবাগতা তিনি বাকিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই সমস্যা একেবারেই হয়নি।
রিমঝিম ঘোষও নিপুণ ভাবে তাঁর চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ঠিক একই কথা বলা দরকার গগনের সহকারী জীবনের চরিত্রে প্রদীপ দাসের ক্ষেত্রে। জীবন তার মালিকের অসহায়তা, অপমান সব কিছু দেখেও তার পাশে দাঁড়িয়েছে। যখন চূড়ান্ত কম্পনে ভেঙে যাচ্ছিল গগন আর সীতার এক টুকরো সংসার, তখন জীবনই একমাত্র সেই মানুষ যে গগনের ভিতরটা দেখতে পেয়েছিল। তার অপরিসীম যন্ত্রণার কথা বুঝতে পেরেছিল। প্রদীপ দাস নিষ্ঠারসঙ্গে তাঁর চরিত্রটিকে প্রাণদান করেছেন। এ ছাড়া এলাকার মাস্টারমশাইয়ের ভূমিকায় পরিমল চক্রবর্তী যথাযথ কাজ করেছেন। দেবুর ভূমিকায় ভাল লেগেছে সমীরণ ভট্টাচার্যের কাজ।
দীপেন সেনের মঞ্চভাবনা, মুরারি রায়চৌধুরীর সঙ্গীত, শক্তি সেনের মেকআপ, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আলো, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধ্বনি ও অমর ঘোষের পোশাকের মধ্যে নব্বইয়ের দশকের গন্ধ লেগে আছে। একটা বিগত কালের আবহ ছড়িয়ে পড়ে উপস্থাপনায়।
উপস্থাপনা শেষে মেঘনাদ ভট্টাচার্য ঘোষণা করলেন যে, এটাই ‘দায়বদ্ধ’ নাটকের শেষ অভিনয়। দর্শক অবশ্য এটা মেনে নিতে রাজি হলেন না। এটা যদি শেষ পারফরম্যান্স হয়ে থাকে, তা হলে বলা যায় যে, বাংলা নাটকের নতুন প্রজন্মের নবীন দর্শক একটি দ্রষ্টব্য নাট্যকর্ম থেকে বঞ্চিত হবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy