জলসাঘর
বিজ্ঞাপনের কাজ ছেড়ে দিয়ে শুধু ছবি বানাবেন ঠিক করেছেন সত্যজিৎ রায়।
অপরাজিত বানালেন। ভেবেছিলেন দর্শক নেবেন। নিল না। চলল না ছবি।
তাই বলে ছবি করা বন্ধ করলে তো চলবে না। এবার এমন ছবি বানাতে হবে যাতে প্রডিউসার দু-পয়সার মুখ দেখতে পান। ভাবতে শুরু করলেন সত্যজিৎ। গ্রামের গল্প, জীবন সংগ্রামের গল্প আর চলবে না।
তাহলে কী?
মাথায় এল, বাঙালি দর্শক চিরকালই ছবিতে নাচগান পছন্দ করেছে। সেইরকম কিছু একটা করতে হবে। খুঁজতে শুরু করলেন গল্প।
হাতে এল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জলসাঘর’। পড়তি জমিদার বিশ্বম্ভর রায়। তহবিল শূন্য কিন্তু জলসার শখ ষোলোআনা। তাই নিয়ে গল্প। দেরি না করে টালায় রওনা দিলেন তারাশঙ্করের বাড়ি।
বললেন ইচ্ছের কথা।
সব শুনে তারাশঙ্কর গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘‘আমার গল্প থেকে যত ছবি হয়েছে সবগুলোই কিন্তু পয়সা দিয়েছে। জলসাঘর-ও হিট করা চাই।’’
তখনও চিত্রনাট্য লেখায় হাত পাকেনি সত্যজিতের। তাই লেখককেই বলে ফেললেন, ‘‘যদি গল্পটার চিত্রনাট্যটা লিখে দেন।’’
রাজি হলেন তারাশঙ্কর।
লেখা শুরু করলেন।
নির্দিষ্ট দিনে আবার সত্যজিৎ রায় গেলেন লেখকের বাড়ি। দেখেন বাঘছালের ওপর বসে কাঠের ডেস্কে কাগজ রেখে লিখে চলেছেন তারাশঙ্কর। সত্যজিৎকে দেখে বললেন, ‘‘ও! আপনি এসে গেছেন। এই দেখুন পড়ে, আমি লিখে ফেলেছি।’’
বাড়ি ফিরে চিত্রনাট্য পড়ে সত্যজিতের মাথায় হাত। সর্বনাশ! তারাশঙ্কর করেছেন কী!
চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে পুরো অন্য একটা গল্প ফেঁদে বসে আছেন! আবার ছুটলেন লেখকের বাড়ি। দু’-এক কথার পর বলতেই হল, ‘‘আপনি নতুন গল্পটাও ভাল লিখেছেন, কিন্তু এই লেখা আমি চাইনি। আমি জলসাঘর থেকেই ছবি করব ভেবেছি।’’
শুনে তারাশঙ্কর বললেন, ‘‘তাহলে আপনি নিজেই চিত্রনাট্য বানিয়ে নিন।’’
রাজি হলেন সত্যজিৎ। ছবিও তৈরি হল। বিশ্বম্ভরের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস। লেখকেরও পছন্দ হল ছবি।
সে ছবি হিট না হলেও লোকসান দেয়নি।
অভিযান
এর পর ‘অভিযান’ কথা। কাহিনিটি নিয়ে ছবি করার ইচ্ছে ছিল না সত্যজিতের।
বন্ধু বিজন চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে তার জন্যই প্রথমে চিত্রনাট্যটা লিখে দিয়েছিলেন। পরিচালনা করছিলেন সেই বন্ধুই।
দুবরাজপুরে শুটিংও শুরু হয়ে গিয়েছিল। সত্যজিৎ সেখানে গেলেন। তারপর হঠাৎই ঠিক করলেন ওই ছবি নিজেই করবেন।
ছবি তৈরি হল। দুবরাজপুরেই পুরো শুটিং। পছন্দও হল দর্শকদের। যে বছর ‘অভিযান’ মুক্তি পেল, সেই বছরই (১৯৬২) মুক্তি পেয়েছিল তপন সিংহর পরিচালনায় ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’।
শুটিং-এর জন্য লাভপুর পৌছেছেন তপন সিংহ। বর্ষাকাল। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। জল-কাদা মেখে কাজ করছে সবাই। হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে তপন দেখলেন ওয়াটাররপ্রুফ পরে স্বয়ং তারাশঙ্কর।
চোখাচুখি হতেই হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘‘এ হে হে দেখো দেখো! শহরের সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়েগুলো জল কাদা মেখে কী চেহারা করেছে দেখো।’’
লেখকের ছোটভাই এক ধামা তেলমাখা মুড়ি আর এক হাঁড়ি বেগুনপোড়া এনে হাজির। লেখক বললেন় , ‘‘নাও হে, অনেক কাজ হয়েছে, এবার সকলে একটু খেয়ে নাও। এরপর চা আসবে।’’
তারাশঙ্কর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বারবার নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন তপন সিংহ। একজন মানুষ গ্রামকে যে কী নিখুঁতভাবে চিনতে পারেন তার প্রমাণ তারাশঙ্কর। গ্রামের ক’টা গাছ আছে, তাও তাঁর কণ্ঠস্থ। ঘরে ঘরে লোকজনকে নাম-নামে চেনেন। সবার শখ-আহ্লাদ-স্বভাব-অভাব যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পান।
যত দূরেই যান, গাঁ-ঘরটা তাঁর মনে যেন ছবি হয়ে ভেসে থাকত!
সত্যজিৎ রায়ের ছবি: সনৎ কুমার সিংহ
তপন সিংহর ছবি: এস রায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy