Advertisement
১৯ মে ২০২৪

উপেক্ষিতা রাজকন্যা

তা’ও কিনা ঔরঙ্গজেব-দুহিতা জেবউন্নিসা! বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস প্রকাশের দেড়শো বছরে তাঁরই অপর এক কাহিনির এই চরিত্রে কেবলই রহস্য পেলেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়বাগদান হয় তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের ছেলের সঙ্গে! বাদশা বাবার জন্যই তাঁর প্রেমিক ফুটন্ত জলে পুড়ে খাক হয়ে যান! দীর্ঘকাল হাজতবাস করেন বাবারই কোপে পড়ে। বাবারই শাসনকালে শেষ জীবন কাটান পুরোপুরি সাধিকার মতো। তিনি জেবউন্নিসা। মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ও সম্রাজ্ঞী দিলরুস বেগমের কন্যা। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের অনেকটা জুড়ে এই জেবউন্নিসার পরিচয় প্রতিহিংসাপরায়ণ, ভোগবিলাসে মত্ত উদ্ধত এক রাজকন্যা।

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

বাগদান হয় তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের ছেলের সঙ্গে!

বাদশা বাবার জন্যই তাঁর প্রেমিক ফুটন্ত জলে পুড়ে খাক হয়ে যান!

দীর্ঘকাল হাজতবাস করেন বাবারই কোপে পড়ে।

বাবারই শাসনকালে শেষ জীবন কাটান পুরোপুরি সাধিকার মতো।

তিনি জেবউন্নিসা।

মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ও সম্রাজ্ঞী দিলরুস বেগমের কন্যা।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের অনেকটা জুড়ে এই জেবউন্নিসার পরিচয় প্রতিহিংসাপরায়ণ, ভোগবিলাসে মত্ত উদ্ধত এক রাজকন্যা।

অথচ কারও কারও ধারণা, বারে বারে প্রেম পড়া এই কন্যা নাকি এক বার মরাঠা অধিপতি শিবাজিকেও ভালবেসে পাগল হয়েছিলেন!

বৈপরীত্যর পর বৈপরীত্য।

রহস্যের পর রহস্য।

গোটা জীবন জুড়ে শুধু রহস্যে মোড়া জেবউন্নিসা আজও যেন জলজ্যান্ত বিস্ময়!

•••

শৈশবে ঔরঙ্গজেব মেয়েকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন অন্য ভাবে। মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ, দরবার থেকে কবি, গায়কদের তাড়িয়ে দেওয়া— এ সব ঔরঙ্গজেবি শাসন-কায়দা জেবউন্নিসার বেলায় ছিল শিথিল।

মেয়ের জন্য গৃহশিক্ষিকা রাখেন সম্রাট। হাফিজা মরিয়ম। হাফিজার কাছে পড়তে পড়তে বছর চারেকের মধ্যেই আরবি আয়ত্ত করে ফেলে শিশু জেবউন্নিসা।

মাত্র সাত বছর বয়সে পুরো কোরান কণ্ঠস্থ করে ‘হাফিজ’ হয়ে গেল সে। মেয়ের সাফল্যে তখন রীতিমতো গর্বিত সম্রাট। প্রাণের জেব-এর সম্মানে দিল্লির ময়দানে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ করালেন। রাজকোষ থেকে প্রায় তিরিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা বিলিয়ে দিলেন গরিব প্রজাদের মধ্যে। উৎসব পালন করতে দু’দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করে দিলেন।

মেয়ের সঙ্গে আরবি, ফার্সিতে নিয়মিত ধর্মতত্ত্ব নিয়ে চিঠি চালাচালিও হতে থাকল ঔরঙ্গজেবের।

অথচ এই ঔরঙ্গজেবই কিনা অন্দরমহলে ধর্ম নিয়ে কথাবার্তাও এক প্রকার নিষিদ্ধই করে দিয়েছিলেন প্রায়।

শুধু ধর্ম-শিক্ষায় অবশ্য মন ভরত না কন্যের। শুরু করলেন কবিতার চর্চা। নিজের মহলে মুশায়েরা বসালেন। কবির লড়াই হল। সে-লড়াইয়ে এসেছিলেন নাসের আলি, বেহরাজ, ওয়ালি উল্লাহের মতো সেই সময়ের বিখ্যাত সব কবি।

কবিতা লিখে নাম কুড়োতে লাগলেন রাজকন্যা নিজেও।

গৃহশিক্ষিকা হাফিজা তাঁর ছাত্রীর কবিতার মধ্যে খুঁজে পেলেন ‘গোটা ভারতবর্ষ’। তাঁর কবিতায় উৎসাহ জোগালেন আরেক মাস্টারমশাই শাহ্ রুস্তম গাজিও। এমনকী কবিতা-প্রেমী মেয়েকে উৎসাহ দিতে লাগলেন সম্রাটও। পারস্য, কাশ্মীরের শ্রেষ্ঠ কবিদের ডাক পাঠালেন দরবারে।

সবই মেয়ের জন্য!

এমনিতে ঔরঙ্গজেব কিন্তু ছিলেন কবিতা-গানের ঘোরতর বিরোধী।

এত কিছুর পরেও বড় হয়ে কিন্তু বাবার সঙ্গে যেন ঠিক হৃদ্যতা জমল না মেয়ের।

•••

দরবারি মহলে জেবউন্নিসা বারবার ছুটে যেতেন তাঁর জ্যাঠামশাই দারা শিকোর কাছে। দারা কাব্য, দর্শনে সুপণ্ডিত। ভাইঝির বেশ কিছু গজল তিনি নিলেন সংকলিত লেখার গ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ দারা শিকো’-য়।

জেঠু-ভাইঝির এই সম্পর্ক ভাল চোখে দেখতেন না ঔরঙ্গজেব।

সময় যতই গড়াতে লাগল, বাবা-মেয়ে যেন একে অন্যের থেকে কেবলই দূরে সরে যেতে লাগলেন।

এক বারের ঘটনা যেমন।

বাগানে পায়চারি করছেন জেবউন্নিসা। হঠাৎ বান্ধবীদের বললেন, ‘জীবনে সুখী হওয়ার জন্য সুরা, ফুল, নদীর স্রোত আর অনাহুত প্রেমিকের মুখ থাকা খুব দরকার।’

কথার মাঝে আচমকা সামনে পিতৃদেব।

এ বার বাবার মন রাখতে জেবউন্নিসা বলে ওঠেন, ‘জীবনে সুখী হতে দরকার প্রার্থনা, উপবাস, কান্না ও অনুতাপ।’

এও তো একরকম। আড়াল-আবডাল ছিল তাতে। দিনে দিনে তাও খসে গেল। শুরু হল সরাসরি সংঘাত।

দাদু শাহজাহানের ইচ্ছায়, জেবউন্নিসার সঙ্গে দারা শিকোর ছেলে সুলেমান শেখের বাগদান হয়ে গেল। বিয়েটা কিন্তু হল না। শোনা যায়, তাতে ঔরঙ্গজেবের হাত ছিল।

সুলেমানকে হারালেন জেব। তবু প্রেম তাঁর হারায়নি। কিন্তু খেয়ালিপনা? ঔরঙ্গজেবের ঔরসে যাঁর জন্ম, খেয়ালিপনা, রহস্যময়তা কি তাঁর অলিখিত চিহ্ন হতেই হবে? আর জীবনের সব প্রান্তেই তার দেখা মিলতেই থাকবে? তাই কি প্রেমের আঁতুড় ঘরেও খেয়ালি-রহস্যের বীজ রেখে ছিলেন জেব?

জেবউন্নিসার অন্য সব পাণিপ্রার্থীর মধ্যে মির্জা ফারুক ছিলেন একেবারে প্রথম সারিতে। তিনি পারস্যের শাহ আব্বাসের পুত্র। জেবউন্নিসার ডাকে দিল্লি চলে এলেন ফারুক।

ফারুক যদি জানতেন এ ডাক ঠিক কীসের!

দিল্লির একটি বাগানবাড়িতে দেখা হল দু’জনের। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ফারুক যখন জেবউন্নিসাকে চুম্বন করতে যাবেন, থামালেন রাজকন্যা।

প্রত্যাখ্যান!

আচম্বিতে প্রেমিকার এমন ব্যবহার ফারুককে স্তম্ভিত করে দিল। পাথরের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেলেন তিনি।

দিল্লি ছাড়লেন না। নগরের এক আবাস থেকেই ‘প্রেমিকা’ জেবউন্নিসাকে চিঠি লিখলেন ফারুক, ‘‘এই প্রেমের মন্দির ত্যাগ করতে পারব না। একাকীত্বের আনন্দ উপভোগ করে যাব শুধু।’’

প্রত্যুত্তরে জেবউন্নিসা মির্জাকে ঠাট্টা করলেন ‘শিশু’ বলে! লিখলেন, ‘‘বিচ্ছেদের আগুনই আসল ভালবাসা।’’

‘প্রেমিক’কে এত রূঢ় প্রত্যাখ্যান কেন করেছিলেন তিনি! কেউ জানে না আজও। হয়তো এই জন্যই ইতিহাস তাঁকে বারবার চিনে এসেছে রহস্যময়ী হিসেবেই।

ভাঙা মন নিয়ে ফারুক ফিরে গেলেন নিজের দেশে। খসে গেলেন তিনি জেবের জীবন থেকে।

•••

প্রেমে পড়েছেন বারবার, কিন্তু জীবনসঙ্গী বেছে নিতে জেবউন্নিসা বরাবরের খেয়ালি। এক দিকে জীবনচর্চায় তাঁর ছিল উদার হাওয়া, অন্য দিকে পর্দার ওপারে মুঘল নারীর আড়ালটুকু ছিল তাঁর পছন্দ।

জীবন আর ভাবনার এই বৈপরীত্যর যোগফল যেন জেবউন্নিসা!

ছদ্মনাম নিলেন, ‘মাকফি’, আড়াল!

জেবউন্নিসার প্রিয়তম কবি ছিলেন সিরহিন্দের নাসের আলি। ওঁর আড়াল-প্রিয়তা নিয়ে এক বার তিনি বলে ফেলেন, ‘‘পর্দা ওঠাও জেব, যদি উপভোগ করতে চাও সৌন্দর্য।’’

প্রত্যুত্তরে জেবউন্নিসা আড়াল থেকেই শুধু লিখেছিলেন, ‘‘আমার কবিতাই আমার পরিচয়।’’

কবিতা। শেষমেশ কবিতা দিয়েই রহস্যময়ী জেবউন্নিসাকে জিতে নিতে এলেন লাহোরের এক প্রাদেশিক শাসনকর্তার পুত্র।

আকিল খান।

তাঁর পরিণতি? নির্মম। আরও নির্মম।

সৌন্দর্য, বীরত্বের জন্য প্রসিদ্ধ আকিল ছিলেন কবিতারও বড় সমঝদার। জেবউন্নিসার কবিতার সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল তাঁর।

কিন্তু তাঁর প্রেম নিবেদন, জেবকে তাঁর জীবনে পাওয়া আর না-পাওয়াও যেন এক অশ্রুতপূর্ব কাহিনি!

অসুস্থ ঔরঙ্গজেব তখন হাওয়া বদলের জন্য সপরিবারে লাহোর। খবর পেয়ে আকিল ছটফট করছিলেন জেবউন্নিসার দেখা পেতে।

নগররক্ষী সেজে রাজকন্যার প্রাসাদের চারপাশে ইতিউতি ঘোরাঘুরি শুরু করলেন আকিল।

আচমকা একদিন ভোরে প্রাসাদের ছাদে দেখাও মিলল জেবউন্নিসার। প্রথম আবির্ভাবেই জেবউন্নিসাকে গালনারের সঙ্গে তুলনা করে বসলেন আকিল। গালনার, আফগানি ফুল।

রাজকন্যা অবশ্য আকিলকে বিশেষ পাত্তা দিলেন না। উল্টে একটু কঠিনই শোনাল তাঁর উত্তর, ‘‘মিনতি, স্তব, সম্পদ অথবা ক্ষমতা দিয়ে আমাকে জেতা সম্ভব নয়।’’

হাল ছাড়লেন না আকিল।

একদিন তাঁর কাছে খবর এল জেবউন্নিসা বান্ধবীদের সঙ্গে একটি নির্মীয়মাণ বাগানবাড়িতে গিয়েছেন।

আকিল মাথায় চুন-সুরকির ঝুড়ি নিয়ে মজুরের ছদ্মবেশ ধরলেন। মূল ফটক পার করার অনুমতিও জোগাড় করলেন।

আকিল দেখলেন বাগানবাড়ির বারান্দায় বান্ধবীদের সঙ্গে ‘চৌসার’ (পাশা) খেলায় ব্যস্ত জেব। মজুরের বেশধারী আকিল উদগ্রীব হয়ে প্রেম নিবেদন করে বসলেন জেবকে, ‘‘তোমার সঙ্গ পেতে ধুলোর মতো সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছি।’’

বেলচা হাতে, ঝুড়ি মাথায় ছদ্মবেশী আকিলকে দেখেও চিনতে অসুবিধে হয়নি জেবউন্নিসার। দ্রুত বলে উঠলেন, ‘‘ধুলো বা বাতাস আমার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না।’’

এর পরেও কী করে যেন দ্রুত জেবউন্নিসার বীতরাগ বদলে গেল অনুরাগে!

মেয়ের এই ঘনিষ্ঠতার খবর ঔরঙ্গজেবের কানে পৌঁছল হাওয়ার গতিতে। এ বার যেন আর আপত্তি নয়, মেয়ের পছন্দকেই স্বীকৃতি দিলেন সম্রাট!

•••

জেবউন্নিসা আকিলকে দিল্লি আসতে বললেন। কিন্তু তার মধ্যেই এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি আকিলকে খবর দিলেন, দিল্লিতে তাঁর জন্য মৃত্যু-ফাঁদ অপেক্ষা করছে।

শুনে প্রচণ্ড ভয় পেলেন আকিল। জেবউন্নিসাকে জানিয়ে দিলেন, এ বিয়ে করতে তিনি অপারগ। তার পরেও না জানি কেন, আকিল লুকিয়ে দিল্লি চলে এলেন।

ফের দেখা হল দু’জনের।

বাগানবাড়ি। গল্পে মশগুল জেব-আকিল। আচমকা ঔরঙ্গজেব আসার খবর পাওয়া গেল। হঠাৎ কোনও এক আশঙ্কায় জেবউন্নিসার মনে ‘কু’ ডাকল। সামনেই ছিল জল রাখার ডেকচি। সেটি দেখিয়ে আকিলকে তক্ষুনি তার ভিতরেই লুকিয়ে পড়তে বললেন।

এ দিকে গোপন সূত্রে আকিল আসার খবর পেয়েছেন ঔরঙ্গজেব। বাগানবাড়িতে তাঁর আগমনের হেতুও তাই।

মেয়েকে দেখেই বললেন—

‘‘কী আছে ডেকচিতে?’’

ভীত সন্ত্রস্ত জেব কোনও ক্রমে উত্তর দিলেন, ‘‘গরম করার জল।’’

ঔরঙ্গজেব হুকুম দিলেন, ওটি উনুনে চাপিয়ে দেওয়া হোক।

কথিত আছে, জেবউন্নিসা তখন ডেকচির কাছে গিয়ে অত্যন্ত ধীর স্বরে বলেছিলেন, ‘‘সত্যিই যদি ভালবেসে থাকো, তবে চুপ থেকো।’’

মৃত্যু শিয়রে দাঁড়িয়ে প্রেমিকের! তবু এটকুই তাঁর উচ্চারণ! জেবউন্নিসা এমনই ছিলেন যে!

পরে তাঁর একটি কবিতায় আকিলের কথা লিখে ছিলেন তিনি। যেখানে আকিল যেন প্রশ্ন করছেন, ‘‘প্রেমিকের ভাগ্যে কী লেখা আছে?’’

কবিতাতেই তাঁর উত্তর দিচ্ছেন জেবউন্নিসা—

‘পৃথিবীর তৃষ্ণার জন্য আত্ম-বলিদান।’

•••

আকিল চলে যাওয়ার পরের জীবনটা আরওই যেন অন্য রকম হয়ে গেল জেবের। রাজকন্যাসুলভ তো নয়ই, বরং অনেক বেশি করে সাধিকার মতো!

নিজেকে পড়াশোনা আর দান-ধ্যানের মধ্যেই ডুবিয়ে দিলেন তিনি। নিজের বাৎসরিক খোরাকির চার লক্ষ টাকার বেশির ভাগটাই বিলিয়ে দিতেন পণ্ডিত, অনাথ শিশু ও বিধবাদের মধ্যে। মক্কা, মদিনার তীর্থযাত্রীদের জন্য টাকা খরচ করতেও কসুর করতেন না।

নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করলেন একটি গ্রন্থাগার। সেখানে মাসমাইনে দিয়ে লিপিকরদের রাখলেন পুঁথি নকল করতে। জেবউন্নিসা নিজেও ছিলেন এক জন লিপিকর।

মোল্লা সফিউদ্দিন তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কোরানের আরবি ভাষ্য ফার্সিতে অনুবাদ করলেন। শোনা যায়, জেবের কাছে কাশ্মীরি পুঁথির একটি বড় সংগ্রহ ছিল। যার একটা বড় অংশ ছিল হিন্দুশাস্ত্রীয় গ্রন্থ।

দরবারের লোকজন অবাক হয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেন, রাজকন্যা দিনে দিনে যেন সাধিকার বেশ ধরছেন। আর পাঁচ জন মুঘল রাজ পরিবারের মেয়েদের মতো সাজগোজ করেন না। চোখে কাজলটুকুও দেন না। অলঙ্কার বলতে গলায় শুধু গোলাপি মুক্তোর মালা। পরনের পোশাকের রং সাদা।

তুর্কিস্তানের মহিলারা ‘আংওয়া কুর্তি’ নামে বিশেষ এক ধরনের পোশাক ব্যবহার করতেন। নিজের জন্য তেমনই পোশাক তৈরি করেছিলেন জেবউন্নিসা। সাদামাঠা এই পোশাকই ছিল তাঁর বেশ।

দরবারের কোনও কিছুর প্রতিই আর আসক্তি রইল না যেন রাজকন্যার! শুধু প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন ভাই মহম্মদ আকবরকে।

সেই ভালবাসাও এক দিন কাল হল।

আকবর বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আজমীরের কাছে মুঘল সেনারা তাঁকে পরাভূত করল। আকবরের শিবির থেকে বাজেয়াপ্ত হল জেবউন্নিসার একাধিক গুপ্ত চিঠি।

ঔরঙ্গজেব আর সইতে পারলেন না।

মেয়েকে কুড়ি বছরের জন্য সেলিমগড় কেল্লার জেলখানায় আটক করলেন।

অথচ কোনও এক সময় দরবারে কোনও সমস্যা সমাধানে এই মেয়েকেই সবথেকে বেশি ভরসা করতেন ঔরঙ্গজেব! রাজকন্যার যে কোনও সিদ্ধান্তে শুধু দরবারি সিলমোহরই পড়ত না, তা পাঠিয়ে দেওয়া হত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

জেলে থাকার দিনগুলি জেবউন্নিসার কাটত কবিতা নিয়ে।

দীর্ঘ কুড়ি বছর হাজতে কাটালেন। এত কাল অন্তরালে থাকা রাজকন্যাকে দিনে দিনে ভুলেই গেল রাজদরবার।

তবে জেবউন্নিসার মৃত্যুর পর মেয়ের সৎকার কিন্তু বেশ ধুমধামের সঙ্গেই করেছিলেন সম্রাট। এমনকী প্রথা মেনে অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত ঔরঙ্গজেব রাজ কর্মচারী আমজাদ খান, শেখ আতাউল্লাদের মাধ্যমে প্রজাদের বহু অর্থ বিলিয়ে দেন।

জেবউন্নিসা হারিয়ে গেলেন।

তাঁর মৃত্যুর বহু বছর বাদে তাঁর শেষ চিহ্নটুকুও মুছে গেল রাজধানী দিল্লি থেকে।

জেবউন্নিসার সমাধিস্থল ছিল ‘তিস্ হাজারি’। লাহোরের নওয়ানকোটে রেলপথ তৈরির সময় সে-সমাধি মিশে গেল ধুলোয়!

কী আশ্চর্য, এক দিন এই জেবই তাঁর প্রেমিককে বলেছিলেন, ‘‘ধুলো বা বাতাস আমার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না।’’

এই নিষ্ঠুর নিয়তির কথা তখন যদি তিনি জানতেন!

তথ্যসূত্র: ‘দ্য দিওয়ান অফ জেব-উন-নিসা: ফার্স্ট ফিফটি গজলস’ (অনুবাদ: মগন লাল, জেডি ওয়েস্টব্রুক। জন ম্যুর, লন্ডন, ১৯১৩), ‘মোগল-বিদুষী’ (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

zebunnisa aurangzeb
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE