Advertisement
১৯ মে ২০২৪

ছক ভেঙেও তুখড়

সায়কের নতুন নাটক। ন’টি লোকগান, ন’রতি হিরে যেন! দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়আশির দশকে স্কালক্যাপ পরা সুনীল গাওস্করের ব্যাটিং-এর সঙ্গে ২০১৪-র নাট্য পরিচালক মেঘনাদ ভট্টাচার্যর কোথাও কি মিল আছে? ‘দাদাগিরি’র গুগলি রাউণ্ডের মতো শোনালেও, সায়ক-এর নতুন নাটক ‘দামিনী হে’ দেখার পর মনে হতেই পারে, আছে। অবশ্যই আছে। ক্লাসিক ক্রিকেটীয় ঘরানার ধরাচুড়ো ছেড়ে গাওস্কর তখন ব্যাট হাতে মার্শাল-ম্যাকডারমট-চ্যাটফিল্ডদের খুন করতেন, আর সানি-প্রেমীদের চোখে তখন বিস্ময়ের অগ্ন্যুৎপাত।

নাটকে মেঘনাদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে কথাকলি

নাটকে মেঘনাদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে কথাকলি

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

আশির দশকে স্কালক্যাপ পরা সুনীল গাওস্করের ব্যাটিং-এর সঙ্গে ২০১৪-র নাট্য পরিচালক মেঘনাদ ভট্টাচার্যর কোথাও কি মিল আছে?

‘দাদাগিরি’র গুগলি রাউণ্ডের মতো শোনালেও, সায়ক-এর নতুন নাটক ‘দামিনী হে’ দেখার পর মনে হতেই পারে, আছে। অবশ্যই আছে।

ক্লাসিক ক্রিকেটীয় ঘরানার ধরাচুড়ো ছেড়ে গাওস্কর তখন ব্যাট হাতে মার্শাল-ম্যাকডারমট-চ্যাটফিল্ডদের খুন করতেন, আর সানি-প্রেমীদের চোখে তখন বিস্ময়ের অগ্ন্যুৎপাত।

এ নাটকে তেমন মেঘনাদও তাঁর এত দিনের সনাতনী নাটকীয় ট্রাম্পকার্ডগুলো বিসর্জন দিয়ে বিস্তর ভাঙাগড়ার মধ্যে জন্ম দিলেন এক নতুন ‘সায়ক’-এর। বিস্ময় তাই পায়ে পায়ে।

‘সায়ক’ বলতেই ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মাপা নিখুঁত সেট, সোজাসাপটা সংলাপ, চেনা দুঃখ-চেনা সুখের গল্প, বিমূর্ততার ‘ব’ নেই। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে গড়ে ওঠা এই অতি পরিচিত ছবিটা ফালা ফালা হয়ে গেছে তাদের নতুন প্রযোজনায়।

ঝুঁকি ছিল দু’রকমের।

এক দিকে এই সময়ে চলতে থাকা একের পর এক শেক্সপিয়র-গ্রিক ক্লাসিক থিয়েটার বা দেশি বিদেশি নাগরিক নাটকের সঙ্গে টক্কর।

অন্য দিকে, সায়ক-এর নিজস্ব ফ্যান ক্লাবের সঙ্গে লড়াই, যাঁরা ‘সায়ক’ বলতেই বোঝেন ‘দুই হুজুরের গপ্পো’, ‘দায়বদ্ধ’, ‘বাসভূমি’, নিদেন ‘কর্ণাবতী’র মতো কাহিনি-নির্ভর ড্রামা।

কাহিনি আছে এখানেও। কিন্তু এত কাব্যিক, এত বিমূর্ততা সায়কের নাটকে আগে কখনও ছিল না।

জেনে বুঝেই ফাটকটা খেলেছেন মেঘনাদ তো বটেই, পাশাপাশি নাট্যকার চন্দন সেনও।

সাহিত্যিক অমর মিত্রের দুটি গল্প, ‘অন্ন’ আর ‘আকাল’। তার সঙ্গে তাঁরই নানা কাহিনি থেকে উপাদান নিয়ে আর পরিচালক-নাট্যকারের কল্পনার মিশেলে তৈরি ‘দামিনী হে’।

আপাতভাবে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া সীমান্তে বাস-করা হাভাতে মানুষের গল্প। ডায়লেক্টও সেই রুখাসুখা লালমাটির, টাঁড় ভূমির। কিন্তু তার মধ্যেই যেন কোথায় একটু হলেও আলাদা তার ভাষা। আলাদা তার ভৌগোলিক বিন্যাস।

চোখে লাগতে পারে, কানে বাজতে পারে, কিন্তু এখানেই কি এ নাটকের কাহিনি টাঁড় মাটিতে আটকে না থেকে হয়ে ওঠে সর্বজনীন?

দামিনী (কথাকলি) ভরা যৌবনা। তাঁর স্বামী কার্তিক (উত্তম দে) মধ্য চল্লিশে দাঁড়িয়েও প্রায়-বাঁজা, জন্মবৃদ্ধ। আখাম্বা গাছের নীচে খাটে শুয়েবসে তার দিন গুজরান হয়।

দামিনীর দাদাশ্বশুর একশো বছরের লক্ষ্মীকান্ত (বিশ্বনাথ রায়)। গাছের কোটরে যার বাস। শ্বশুর গণেশ (প্রদীপ দাস) প্রায় পঁচাত্তর। সারাদিন কোমর ঘষটে ঘষটেও ওই ন্যুব্জ বুড়োর আদিরস শুকোয় না।

এ-সংসারে একমাত্র সমর্থ বলতে ওই দামিনী। ভরন্ত যৌবনের নানা প্রলোভন, ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে মাঠ ঘাট পেরিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে হত্যে দেয়। সরকারের দেওয়া পেনশন স্কিম, বার্ধক্যভাতা জোগাড়ের চেষ্টায় থাকে। ওটুকু টাকাতেই যে খেয়ে, না-খেয়ে তার ‘তিন বুড়া’-র সংসার চলে। বুড়ারা তো আর যে-সে ‘বুড়া’ নয়, ‘সোয়ামি-শউর-দাশউর’ই শুধু নয়, ওরা যে তার সব।

দামিনী গান গায়। প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলে। তার ভয়ার্ত মুহূর্তে তাকে কোলে ধরে আগলে রাখে কখনও প্রান্তর। কখনও’বা গাছ।

দামিনী সন্তান চায়। কিন্তু পরপুরুষের ঔরসে নয়, তার বিশ্বাস ভগবানই তার কোল ভরাবে। প্রকৃতিই তাকে সন্তান দেবে। পরাগমিলনের পরে যেমন গাছে লাগে ফুল। দামিনীর সংসারকে ঘিরেই বেড়ে ওঠে জটা পাহাড়ের কোলে বাগডোর গাঁয়ের কথকতা।

এ গাঁয়ে জন্ম-ইস্তক লোকে ‘বুড়া’ হয়। সরকারি দয়ায় সরীসৃপের মতো বাঁচে। তবু জল-জঙ্গল-জমিন এদের ‘ভগমান’। পুলিশের তাড়া খেয়ে, গুলিতে প্রাণ দিয়েও সেই ‘ভগমান’-কে রক্ষা করতে গিয়ে এ তল্লাটে প্রাণ দিয়েছে অনেকে। রাত নামলে মাঝে মাঝে অশরীরী হয়ে তারা ফিরেও আসে।

বাগডোরের চোরা হাওয়ায় বাসা বাঁধে মিঠা বুরুর স্বপ্ন। দিনে দিনে সেই স্বপ্নই তাদের শেখায় — দয়ায় নয়, বাঁচতে হলে ইজ্জত নিয়ে মরদের মতো বাঁচতে হয়। মিঠা পাহাড়ের মিঠা মাটি খেয়ে।

ধামসা, মাদল, শিঙা, বাঁশির সুরে, লোকগানে গ্রাম জুড়ে ঘুরে বেড়ায় সে-স্বপ্ন পিয়াস।

শুভেন্দু মাইতির হাতে বোনা এ নাটকের ন’টি লোকগান, ন’রতি হিরে যেন! সে-হিরের অধিকাংশরই ধারক হয়ে কথাকলি গোটা নাটকে তার সর্পিল অঙ্গচালনায়, অতিমধুর কণ্ঠ দিয়ে এমন মায়া ছড়ায়, যে স্তম্ভিত না হয়ে যাই কোথা! অভিনেত্রী-সুকণ্ঠী সুরঞ্জনা দাশগুপ্তের কন্যা কথাকলি তার মায়ের যৌবনবেলায় করা ‘সধবার একাদশী’ আর ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’-কে মনে করিয়ে দিল।

অনবদ্য ‘তিন বুড়া’র সঙ্গে দালাল বনমালী (মেঘনাদ ভট্টাচার্য)-র অভিনয়ও। কিংবা পঞ্চায়েত প্রধান যুধিষ্ঠির (সুব্রত ভাওয়াল)। তুলনায় একটু হলেও দলছুট লাগে বিডিও অফিসের বড়বাবু কল্যাণকে (ধূজর্র্টি দে)।

আর এই প্রথম বোধহয় সযত্নে নিখুঁত হতে না-চাওয়া সায়ক-এর সেট, ভাবনাকে নিয়ে যায় মার্জিনের বাইরে। মঞ্চ জুড়ে থাকা বিশাল বট গাছ সেখানে কখনও গিলে খেতে চাওয়া সমাজের ক্যানভাস, কখনও আবার হা-ঘরে মানুষের আশ্রয়। ঝুঁকি নিয়েও জিতে যায় ‘সায়ক’। সরাসরি নয়, স্বপ্নালু, বেদনাতুর বিমূর্ত কাহিনিকে মঞ্চায়ন করেও।

এ ভাবেই তো জন্ম নেয় বিস্ময়ের অগ্ন্যুৎপাত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE