Advertisement
০১ মে ২০২৪
খরায় যখন চার দিক পুড়ছে, তখন বৃষ্টির আকুল প্রার্থনায় ঘন অন্ধকারে এই দেবতার আরাধনা করতেন নারীরা। অনুষ্ঠানে ধারেকাছে পুরুষ নিষিদ্ধ। হুদুম দেবতা খুশি হলে মেঘ করবে, বৃষ্টি নামবে, এই আশায় রাতভর চলত নাচগানের মাধ্যমে প্রার্থনা। এই লৌকিক আচার এখন অবলুপ্তির পথে।
Bengali Feature

মেঘ ও বৃষ্টির প্রার্থনাতেই পূজিত হন হুদুম দেও

বিদ্ধেশ্বরী উত্তরবঙ্গের কৃষক রমণীদেরই এক জন। আর এখানেই সেই কৃষক রমণীদের ভরসা, ‘হুদুম দেও’। এক কালো ঘন অন্ধকার রাতে নারীর দল জড়ো হয় ‘হুদুম দেও’য়ের সামনে।

Puja.

আরাধনা: মাঝে হুদুম দেবতার খুঁটিকে রেখে চলছে গ্রামীণ মহিলাদের পুজোর আয়োজন।

নমিতেশ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ০৪:২৬
Share: Save:

চার দিকে প্রচণ্ড দাবদাহ। সূর্যের প্রখর তেজে জমির ফসল পুড়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাজক্রম বন্ধ হতে বসেছে। রোজগার বন্ধ হলে বাড়ে খিদে। আশঙ্কা বাড়ে অনাহারে মৃত্যুর। তার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষের লড়াই চলছে আবহমান কাল ধরে। কখনও কখনও মানুষ এই লড়াইয়ে দেবতার শরণাপন্ন হয়েছেন তাঁর আনুকূল্য পেতে। এমনই এক হারিয়ে যেতে বসা লৌকিক দেবতা হলেন হুদুম দেও।

সূর্য তখন মধ্যগগনে। ধান গাছের পাতাগুলি রোদের তাপে হলদেটে। আলের ধারে ছাতা মাথায় বসে রয়েছেন বিদ্ধেশ্বরী। মাঝে মাঝে মুখ তুলে চাইছেন আকাশের দিকে। মুখ জুড়ে দুশ্চিন্তার ছাপ। গুনগুন করে গেয়ে উঠছেন “হুদুম দেও হুদুম দেও, এক ছলকা পানি দেও/ ছুয়ায় আছি নাই পানি/ ছুয়া ছুতি বারা ভানি/ কালা ম্যাঘ, ধওলা ম্যাঘ সোদর ভাই/ এক ঝাক পানি দেও গাও ধুবার চাই।” বিদ্ধেশ্বরী ‘মেঘদেবতার’ কাছে বৃষ্টি চাইছে। বিদ্ধেশ্বরী জানে, বৃষ্টি না এলে সংসারে নেমে আসবে অনিশ্চয়তা। অভুক্ত কাটাতে হবে দিন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে উত্তরবঙ্গের যে কোনও প্রান্তে ধরা দিতে পারে এমন চিত্র। বিদ্ধেশ্বরীর মধ্যে যেন প্রতিফলিত হয়ে ওঠে ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর ফুল্লরা।

তখন ষোড়শ শতক। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন ‘চণ্ডীমঙ্গল’। সেখানে ব্যাধ রমণী ফুল্লরার ‘বারোমাস্যা’ বর্ণনায় বলছেন, “অনল সমান পোড়ে বৈশাখের খরা।/ তরুতল নাহি মোর করিতে পসরা।/ পদ পোড়ে খরতর রবির কিরণ।” কালবৈশাখের ঝড়ে প্রায়ই তাঁর ঘর ভেঙে যায়। বৈশাখের খরতাপে তাঁর দিন গুজরান কঠিন হয়ে পড়ে। পসরা সাজিয়ে নেওয়ার মতো গাছের ছায়াও সে খুঁজে পায় না। রবিতাপে উত্তপ্ত বালুকায় পা রাখা যায় না। তাঁর পরিধেয় বস্ত্র এতটাই কঠিন যে, তা দিয়ে মাথা ঢাকারও কোনও উপায় নেই। ফুল্লরা বলছেন, “পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড তপন।/ খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ।/ পসরা এড়িয়ে জল খাত্যে যাত্যে নারি।/ দেখিতে দেখিতে চিল লয় আধা সারি।/ অন্ন নাহি মেলে এই পাপ জষ্ঠি মাসে।/ বেঙচির ফল খেয়ে থাকি উপবাসে।” জ্যৈষ্ঠ মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এই মাসে তাঁর ব্যবসা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে, অনেক সময় দু’টি ভাতও জোটে না, তাঁর পরিবারকে বেঙচির ফল খেয়ে দিন গুজরান করতে হয়। বর্ধমান বা মেদিনীপুর থেকে উত্তরবঙ্গ অনেকটাই দূরে। কিন্তু মানুষের আর্থিক কষ্ট কোথাও যেন এক হয়ে উঠেছে।

বিদ্ধেশ্বরী উত্তরবঙ্গের কৃষক রমণীদেরই এক জন। আর এখানেই সেই কৃষক রমণীদের ভরসা, ‘হুদুম দেও’। এক কালো ঘন অন্ধকার রাতে নারীর দল জড়ো হয় ‘হুদুম দেও’য়ের সামনে। তাঁরা তাঁদের নাচে-গানে হুদুমকে তুষ্ট করার পালা চালিয়ে যায়। মশাল জ্বালিয়ে চলে সেই পর্ব। পুরুষের চোখ এড়িয়ে নারীর দল রাতভর হুদুমকে খুশি করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। হুদুম খুশি হলে বৃষ্টি নামবে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে যাবে উত্তরবঙ্গের এই খেত-মাঠ। ফসলে ফসলে কানায় কানায় ভরে উঠবে চার দিক। এই বিশ্বাস রমণীদের মনে-প্রাণে।

কৃষিজ ফসলই উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক মানুষদের বেঁচে থাকার রসদ। কোচবিহার তথা গোটা উত্তরবঙ্গ এবং নমনি অসম, বাংলাদেশের রংপুর, উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি বড় অংশের রাজবংশী সম্প্রদায়ে এই পুজোর প্রচলিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই অংশের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। তাঁরা ধান, পাট, ভুট্টা, তামাক, আলু, আনাজ, ডাল উৎপাদন করেন এবং তা বাজারে বিক্রি করেই দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা করেন। এক সময় এই অঞ্চলে ফসল ফলানো খুব কঠিন হত। বিদ্যুৎ ছিল না। ডিজেল কিনে পাম্প সেট চালানো তখন অনেকেরই ভাবনার বাইরে। একমাত্র ভরসা ছিল প্রকৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে। এখনও কৃষিকাজের জন্য বৃষ্টি অপরিহার্য। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অর্থকরী ফসল ধান, পাট, তামাক চাষ হয়। এই সময়ে বৃষ্টির জন্য চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন কৃষকরা। বৃষ্টি না হলে কৃত্রিম সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফসলের উৎপাদনের খরচ এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যাবে। তার পরেও খরায় মাঠের পর মাঠ ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এক সময় কৃত্রিম সেচের ব্যবস্থাও ছিল না। বৃষ্টি না হলে ফসল বাঁচানো কঠিন হয়ে যেত। চাষির ঘরে নেমে আসত দুর্দশা। উত্তরের এই ফুল্লরাদের সেই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়।

“ওঠ হুদুম চৈতন হান চক্ষু মেলি চাও/ আগুনে না পোড়া গেইছে মোর সর্বগাও/ ওরে ম্যাঘ কালা ম্যাঘ দুইজনে সোদর ভাই/ হুদুম চেতন হইছে এলা এয়াও ধুইয়া বাড়ি যাই”— এখনও বহু গ্রামে বহু বয়স্কা মহিলার মুখে মুখে ঘোরে হুদুমের গল্প। কেউ কেউ সেই পুজোর সঙ্গীত বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন। অনেকেই হদুম দেও পুজোকে ‘মেঘপুজো’ও বলে। বলা হয়, হুদুম আসলে বৃষ্টির দেবতা বরুণ বা ইন্দ্র। যতটুকু এখনও জানা যায়, হুদুমের পুজো করা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের যে কোনও শনিবার বা মঙ্গলবার। বিবাহিত ও বিধবা মহিলারা পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। কুমারী মেয়েদের পুজোয় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। গ্রামের কোনও গোপন জায়গায় গিয়ে নৃত্যগীতের মাধ্যমে পুজো করা হয়। গোপন বলতে এমন একটি জায়গা, যা পুরুষের চোখ থেকে দূরে। গভীর অন্ধকার রাতে মশাল জ্বালিয়ে হয় পুজো। পুজোর জন্য কিছুটা জায়গা আগে থেকে তৈরি করে নিতে হয়। সেই জায়গায় একটি গর্ত করা হয়। পুজোর জন্য প্রয়োজন হয় কোনও এক সন্তানের মায়ের স্নানের জল, ফিঙে পাখির বাসা, গণিকার চুল, একটি কলাগাছ, জলপূর্ণ ঘট, কুলো, ধূপবাতি, নৈবেদ্য, গোটা পান-সুপারি এবং বরণডালা। সেই গর্তে পুজোর উপকরণ ঢেলে দিয়ে কলাগাছ পুঁতে দেওয়া হয়। এই কলাগাছটি এক সন্তানের মাকে রাতের অন্ধকারে কেটে আনতে হয়। কলাগাছে একটি মার্কিন কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়। এই খুঁটি পোঁতার সাত দিন আগে প্রধান পূজারিনির (যিনি পুজোর সঙ্কল্প গ্রহণ করেন) আহ্বানে প্রতিদিন সাত-আট জন মহিলা ‘মাগন’ করতে বেরোন। দলনেত্রী আগে যান লাঠি ঠুকতে ঠুকতে শব্দ করে— “আগ দুয়ারি কে রে/ পাছ দুয়ারি কে রে/ আসিছে হুদুমা দুয়ার খুলিয়া দে রে।” বিভিন্ন বাড়ি থেকে ‘মাগন’ করে আনা সাত ঘরের জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় সেই গাছে।

এর পরে সবাই স্নান করে নেন। কুলোয় সেই রমণীর স্নান করা জল ঢেলে ছিটিয়ে দেওয়া হয় মেঘ দেবতার প্রতীক সেই কলাগাছটিতে, সেই জল দিয়ে তাঁকে স্নানও করানো হয়। তার পরেই বারো শস্য দিয়ে কলাগাছের নীচে ঘট স্থাপন করে ধূপ-বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ ভাবেই পুজো শেষ হলে শুরু হয় আবাহন পালা। এই নৃত্যগীতে রঙ্গ রসিকতা, অনুনয়-বিনয়, শ্লেষ-ধিক্কার, প্রেম দিয়ে হুদুমকে মোহিত করার চেষ্টায় ভরে ওঠে। এক দল নারী কলাগাছের অদূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে গীত শুরু করেন। আর এক দল নারী কলাগাছের চার দিকে গোল হয়ে নৃত্য শুরু করেন। নৃত্যগীতে অধিবাস থেকে শুরু করে বিবাহ, বিরহ, মিলন, দেবতার কৃপা ভিক্ষা সব কিছুই গীত হয় মহিলাদের দ্বারা। এই নৃত্যগীতের উদ্দেশ্য হুদুম দেবতাকে খুশি করা। ওই অনুষ্ঠানে পুরুষদের যোগ দেওয়া অথবা দেখা, দুই-ই নিষিদ্ধ। নারীদের বিশ্বাস, যে কোনও পুরুষ ওই অনুষ্ঠানের নাচ দেখলে হুদুম রাগ করেন, ফলে বৃষ্টি না হওয়ার আশঙ্কা। সকলে বিশ্বাস করেন হুদুম দেবতা বৃষ্টি দেন। সেই বিশ্বাসেই এখনও আকাশের পানে চেয়ে থাকেন বিদ্ধেশ্বরীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Feature village puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE