Advertisement
১৬ মে ২০২৪
ancient

সমাধি আর অভিশাপেই বিখ্যাত তুতানখামেন

তুতানখামেন মিশরের ফারাও হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে আসেননি। তিনি ছিলেন পুরোহিততন্ত্রের হাতের পুতুল।

স্মৃতিসৌধ: লাক্সর মন্দিরে তুতানখামেন ও আঁখেসেনামুন-এর মূর্তি।

স্মৃতিসৌধ: লাক্সর মন্দিরে তুতানখামেন ও আঁখেসেনামুন-এর মূর্তি।

তিলক পুরকায়স্থ
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২১ ০৭:০৯
Share: Save:

ফারাও হিসেবে মোটেই তেমন গুরুত্বপূর্ণ নন। কিন্তু তাঁর মমির সঙ্গে পাওয়া রাজকীয় ঐশ্বর্য টেক্কা দিয়েছিল বাকিদের। উপরি পাওনা মৃতের প্রতিশোধ নেওয়ার অলৌকিক কিংবদন্তি।

তুতানখামেন ছিলেন ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ বা আখেনাতেনের জামাই। আখেনাতেন-এর স্ত্রী ছিলেন সুন্দরী নেফারতিতি। এঁদের পুত্রসন্তান ছিল না, ছিল সাতটি কন্যা। এঁদেরই এক জামাই তুতানখামেন। তিনি মিশরের ১৮তম রাজবংশের সবচেয়ে কম দিনের বালক রাজা। তাঁর জন্ম সম্ভবত আমরানাতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪১ অব্দে, এবং রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩২-১৩২৩। বালক রাজার শ্বশুর চতুর্থ আমেনহোটেপ ছিলেন এক ব্যতিক্রমী সম্রাট। থিবস নগরের আড়ম্বর ও জাঁকজমক ত্যাগ করে তিনি নতুন রাজধানী তৈরি করেন প্রাচীন থিবস ও মেমফিস নগরের মাঝখানে, টেল-এল-আমরানা নামক গ্রামের কাছে।

তুতানখামেন মিশরের ফারাও হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে আসেননি। তিনি ছিলেন পুরোহিততন্ত্রের হাতের পুতুল। তুতানখামেনের আসল নাম ছিল শ্বশুরের পূজিত সূর্যদেব বা আটন-এর নামে, তুত আনখ আটন। প্রথমেই পুরোহিতদের আদেশে তিনি তাদের পছন্দের দেবতা আমনের নামে নাম বদল করে নতুন নাম নেন, তুত আনখ আমন, বা তুতানখামেন। মিশরের মন্দিরে মহাসমারোহে আমন দেব আবার পুজো পেতে লাগলেন। সারা দেশ থেকে দেবতা আটন এবং আখেনাতেন-এর নাম মুছে ফেলা শুরু হল। রাজধানী আবার আমরানা থেকে থিবস নগরীতে ফিরে এল।

পুরোহিতদের হাতের পুতুল, শ্বশুরের নাম ও পূজিত দেবতাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন, তবুও প্রচারের সব আলো তুতানখামেনের উপরেই মাত্র একটি কারণে। তাঁর সমাধি থেকে উদ্ধারকৃত অতুল ঐশ্বর্যের জন্য। মিশরের ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট এই সমাধির মধ্য থেকে পাওয়া গেছে ৫,৩৯৮টি অপরূপ সামগ্রী। সোনার মুকুট, সোনার শবাধার, তুতানখামেনের মমি একটির ভিতর আর একটি, এভাবে তিনটি সোনার আধারের মধ্যে রাখা ছিল। বহুমূল্য রত্নরাজি ছাড়াও পাওয়া গিয়েছে উল্কাপিণ্ডের লোহা দিয়ে নির্মিত সুদৃশ্য ছোরা, হাতির দাঁতের হাতলের সঙ্গে উটপাখির পালকের হাতপাখা ইত্যাদি। এ ছাড়াও পাওয়া গিয়েছে অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের মূর্তি। আর একটি অদ্ভুত কাঠের জানোয়ারের মূর্তি উদ্ধার হয়েছে যার শরীর ও পা বেড়ালের, মুখটা ঘোড়ার, মুখে গজদন্ত দ্বারা নির্মিত বিড়ালের মতো তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত। এই সমাধি থেকে পাওয়া রাজকীয় ঐশ্বর্যের পুরোটাই প্রায় তাঁর শ্বশুর ও দাদাশ্বশুরের সম্পত্তি। তুতানখামেনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মিশরের ইতিহাসের ১৮তম রাজবংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।

তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কার হওয়ার পর সারা পৃথিবীতে যেমন সমাধি থেকে প্রাপ্ত অতুল ঐশ্বর্যের চর্চা শুরু হয়, তেমনি আবার দু’টি মুখরোচক গল্প সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমের চর্চার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথমটি হচ্ছে, তুতানখামেনের হত্যারহস্য। বলা হয়, অত্যন্ত দুর্বল স্বাস্থ্যের এই ফারাওয়ের কোনও বংশধর না থাকায়, ক্ষমতা দখলের লোভে তার স্ত্রী আঁখেসেনামুন নাকি তাঁদের ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ানকে দিয়ে তাঁকে হত্যা করান। রটনার ভিত্তি, এক্স রে করে দেখা গেছিল যে তাঁর পায়ের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত। তা ছাড়া মাথার পিছনে খুলির হাড়ও একটু বসা ছিল। তাই এসব গল্পকথার আগমন।

কিন্তু পরে প্রমাণিত যে, সেই সময়ে ফারাওদের নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই বিয়ে হত। সম্ভবত সেই কারণেই তুতানখামেনের অসংখ্য জিনগত রোগ ছিল। পায়ের সমস্যায় ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না, বেতের ছড়িতে ভর দিয়ে চলতেন। তাঁর ব্যবহৃত ছড়িগুলি সমাধির মধ্যেই পাওয়া গেছে। এছাড়াও গন্নাকাটা বা ক্লেফ্ট প্যালেট সমস্যার জন্য নাকি সুরে কথা বলতেন। বিজ্ঞানীদের মত, এত কম বয়সে মৃত্যুর কারণ সম্ভবত মিশরের কুখ্যাত প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম মশার কামড়।

দ্বিতীয় মুখরোচক গল্প হল, তুতানখামেনের অভিশাপ। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই আসবে বিশিষ্ট মিশর-বিশেষজ্ঞ হাওয়ার্ড কার্টারের নাম। ধনকুবের লর্ড কার্নারভনের সহযোগিতায় শুরু হয় ইতিহাসে বিস্মৃত তুতানখামেনের সমাধি খুঁজে বের করার প্রয়াস। কারণ ততদিনে ইতিহাসবিখ্যাত ফারাওদের পিরামিড এবং কিংস ভ্যালির সমাধিগুলি তন্নতন্ন করে খুঁজেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ১৯২২ সালের ২৬ নভেম্বর তুতানখামেনের মূল সমাধিগৃহে প্রবেশ করা হয়। সমাধিটি মাত্র ১১০ বর্গফুট আয়তনের।

এই অসাধারণ আবিষ্কার সারা পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলে। সেযুগের গণমাধ্যমও কাগজের কাটতি বাড়াতে তুতানখামেনের মমির অভিশাপ নাম দিয়ে অলৌকিক সব খবর ছাপতে থাকে। কেউ লেখেন, সমাধির উপরে উল্লেখ করা আছে, বাইরের কেউ সমাধিতে প্রবেশ করলে মৃত্যু অনিবার্য। কেউ কেউ সমাধির মধ্যে রক্ষিত শেয়ালদেবতা অনুবিস ও মমি নিয়ে নানা মনগড়া স্টোরি ছাপেন। এঁরা কেউ হিয়েরোগ্লিফিক লিপি না বুঝেই লিপির বক্তব্য বুঝে ফেলতেন!

অভিশাপের নামে যেসব গালগপ্পো বহুল প্রচারিত ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল,

১) ফারাওদের রাজমুকুটে উদ্যতফণা গোখরো সাপের মূর্তি থাকত। সমাধি উন্মুক্ত করার দিন ঘরে ফিরে কার্টার সাহেব দেখেন যে, একটি মিশরীয় গোখরো তাঁর পোষা হলুদ ক্যানারি পাখিটিকে গিলে খাচ্ছে।

২) দাড়ি কাটতে গিয়ে খুরে গাল কেটে যাওয়া কিছু আশ্চর্য নয়। কিন্তু প্রজেক্টের পৃষ্ঠপোষক লর্ড কার্নারভনের ক্ষেত্রে তা হয়ে দাঁড়ায় সেপ্টিসেমিয়া। তখন ওষুধপত্র তত উন্নত ছিল না, তাই ১৯২৩ সালের ৫ এপ্রিল কায়রোতে ওঁর মৃত্যু ঘটে। আবার কাকতালীয় ভাবে ওই দিন সকালেই নাকি লন্ডনে তাঁর পোষা কুকুরটিও মারা যায়। দুয়ে দুয়ে চার করে ভয়ঙ্কর সব গল্প ছড়িয়ে পড়ে।

৩) এর পর এই উৎখনন কাজের সঙ্গে যুক্ত লোকেদের পরিবারের কারও কিছু হলেই, মমির অভিশাপের গল্প জুড়ে দেওয়া হত। লর্ড কার্নারভনের এক সৎভাই অন্ধ হয়ে যান, কার্টারের এক সহযোগী আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় মারা যান— সবই নাকি মমির অভিশাপের ফল।

আর হাজার হাজার বছর ধরে চোরের দল, কবরে ঢুকে সব কিছু লুটেপুটে নিয়ে গেছে, গিজার বড় বড় পিরামিডের মধ্যে আর একটিও মমি অবশিষ্ট নেই, তাদের উপরে কোনও অভিশাপ বর্ষণ হয়নি। গত শতকেও কায়রোর রাস্তায় প্রকাশ্যে সারি সারি মমি বিক্রি হত, সেসব নিয়ে কোনও গল্প নেই। স্বয়ং হাওয়ার্ড কার্টার সুস্থ শরীরে ৬৪ বছর অবধি বেঁচে ছিলেন।

সেই ঘটনার প্রায় একশো বছর হতে চলল। কিন্তু মমির অভিশাপ নিয়ে লাগাতার টিভি শো, সিনেমা-র বিরাম নেই। কারণ মানুষ গল্প শুনতে চায়, আর কে না জানে, গল্পের বাজারে ভূত প্রেত বা অলৌকিক কাহিনির কোনও মার নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Egypt ancient tutankhamun
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE