আমার স্মৃতি যদি খুব একটা বেইমানি না করে, তা হলে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে আমি প্রথম দেখি ২০০২ সালে আগরতলায়। আমি তখন বাংলার কোচ। আমাদের সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের পূর্বাঞ্চলীয় ওয়ান ডে ম্যাচ। সত্যি বলছি, উইকেটের পিছনে লম্বা চুলের ছেলেটাকে দেখে মনে তেমন দাগ কাটেনি। উইকেটকিপিং ঠিকঠাকই করেছিল, কিন্তু দুর্দান্ত কিছু মনে হয়নি।
তা হলে কী জাদুমন্ত্রে ১৫ বছর পরে সেই ছেলেটার ওয়ান ডে-তে একশো স্টাম্পিং হয়ে গেল, ২৮৩টা ক্যাচের পাশাপাশি? এর সঙ্গে রয়েছে টেস্ট ক্রিকেটে ২৫৬ ক্যাচ, ৩৮ স্টাম্প।
ধোনির কিপিংয়ের ইউএসপি হল ওর স্টাম্পিং করার ক্ষমতা। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, টেস্টে তো ধোনির স্টাম্পিং সংখ্যা আদৌ বেশি নয়। তাদের বলতে চাই, টেস্টে কিন্তু ব্যাটসম্যানরা খুব ভেবেচিন্তে ঝুঁকি নেয়। আবার স্টেপআউট করলেও স্টাম্পিংয়ের সুযোগ বিশেষ দেয় না। আমি বেশ কয়েক জন ব্যাটসম্যানকে জানি, যারা টেস্টে স্টেপআউট এত ভাল করত যে স্টাম্পিংয়ের সুযোগই দিত না। যেমন নভজ্যোত সিংহ সিধু, সুনীল গাওস্কর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
গত ১৫ বছরে ধোনিকে মাঠে এবং টিভি-তে দেখে আমি একটা জিনিস বুঝেছি। ধোনির মতো উইকেটকিপার কিন্তু কোচিং করিয়ে তৈরি করা যায় না। এরা সহজাত দক্ষতা নিয়েই আসে, নিজেরাই নিজেদের স্টাইল তৈরি করে নেয়।
আরও পড়ুন: এনবিএ-কেও টেক্কা দিচ্ছে আইপিএল
নিজে একটা পর্যায় পর্যন্ত কিপিং করেছি বলে বুঝতে পারি, ধোনি ব্যকরণ মেনে কিপ করে না। ওর গ্লাভসের পজিশন কোচিং ম্যানুয়াল মেনে থাকে না। ধোনিকে দেখে আমার আর এক জন কিপারের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে। যে ধোনির মতোই কপিবুক কিপিং না করেও বিশ্বের অন্যতম সেরা হয়ে উঠেছিল। সৈয়দ কিরমানি। ধোনির মতো কিরির কিপিংয়েও একটা সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইল ছিল। যেটা ওরা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছিল।
ধোনির সাফল্যের ফর্মুলাটা খুঁজতে বসলে প্রধান যে উপাদানগুলো উঠে আসছে, তা হল: এক, আত্মবিশ্বাস। যেখানে ও বাকিদের থেকে কয়েক শো গজ এগিয়ে। দুই, ঠান্ডা মাথা। কোনও সময় ম্যাচ থেকে হারিয়ে যায় না। এমনকী একটা ক্যাচ ফস্কালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ‘ডিলিট-কি’ টিপে মুছে ফেলে। তিন, ফিটনেস। মারাত্মক ফিট না হলে আপনি টেস্টে দিনে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বল আর ওয়ান ডে-তে তিনশো বল উইকেটের পিছনে ওঠ-বোস করতে পারবেন না। এই ফিটনেসের দৌলতে ও ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলে দিলে আমি অবাক হব না। চার, ক্ষিপ্রতা। ওর স্টাম্পিংয়ের রেকর্ডই বলে দিচ্ছে ধোনি কত ক্ষিপ্র। পাঁচ, সহজাত প্রতিভা।
ধোনিকে কেন সহজাত প্রতিভা বলছি? তার কারণ ও এমন কিছু ক্যাচ এবং স্টাম্প করেছে, যা শেখানো যায় না। যেমন আর. অশ্বিনের বলে ইনসাইড এজে লাগা বল ধরে নেওয়া। যেমন লেগ সাইডে বল ধরে স্টাম্প করা। এমনিতে ডান হাতি ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে ভিতরে আসা বল বা লেগ স্টাম্পে পড়া বল কিপারদের ধরতে সমস্যা হয়। কারণ বলটা সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য কিপারদের ব্লাইন্ড জোনে চলে যায়। দেখা সম্ভব হয় না। কিন্তু তাও দুর্দান্ত অনুমানক্ষমতা এবং রিফ্লেক্সের জন্য ধোনি গ্লাভসটাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। বলটা ওই সময় ঠিকমতো ধরতে না পারলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে স্টাম্প করা সম্ভব নয়।
ধোনিকে দেখে এক একটা সময় মনে হয় ও যেন উইকেটকিপিংয়ের বীরেন্দ্র সহবাগ। যে সেই সহজাত প্রতিভা যে কোচিং ম্যানুয়াল মেনে কিছু করবে না। যাকে কোচেরা কিছু শেখাতে পারবে না। যে নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করবে। আর সেই স্টাইল মেনে খেলেই সফল হবে।
ব্যাটসম্যান, ফিনিশার ধোনির জন্য কিপার ধোনি কিন্তু অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছে। কিপার হিসেবে সঠিক মূল্যায়নও হয়নি ওর। স্টাম্পিংয়ের সেঞ্চুরিটাই আবার সেই কিপারকে সামনে নিয়ে এল।
কিপার ধোনির কীর্তি
• ওয়ান ডে-তে উইকেট শিকারের দিক থেকে চার নম্বরে এমএস ধোনি। তাঁর শিকার ৩৮৩। ধোনির আগে এই তালিকায় আছেন কুমার সঙ্গকারা (৪৮২), অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (৪৭২) এবং মার্ক বাউচার (৪২৪)।
• ওয়ান ডে-তে সর্বোচ্চ স্টাম্পিংয়ের রেকর্ড (১০০)। সদ্য শেষ হওয়া সিরিজে টপকে গিয়েছেন শ্রীলঙ্কার কুমার সঙ্গকারাকে (৯৯)।
• টেস্ট ম্যাচে উইকেটকিপারদের সর্বোচ্চ শিকারিদের তালিকায় পাঁচে ধোনি। তাঁর শিকার ২৯৪। যার মধ্যে ২৫৬ ক্যাচ এবং স্টাম্পিং ৩৮। শীর্ষে মার্ক বাউচার (৫৫৫)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy